করোনা মহামারি দেশের ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান দুর্বলতাকে আরো বাড়িয়েছে। এর ফলে মধ্যমেয়াদে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে বেঁধে দেওয়া সুদ হার পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আর্থিক নীতিকাঠামো আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে মুদ্রা মানও নমনীয় করারও সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণ করে এমন সুপারিশ করেছে আইএমএফ।
গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরের পর আইএমএফ প্রতিনিধি দল আর্টিকেল-ফোর এর অধীনে এই পর্যবেক্ষণ তৈরি করেছে। বোর্ড সভায় পর্যালোচনার পর সম্প্রতি এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যাপ্ত রয়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটি রিজার্ভ সংরক্ষণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে। বিশেষ করে অ-আর্থিক উদ্দেশে রিভার্জ ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করা হযেছে।
ব্যাংকিং সেক্টরে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী করার গুরুত্ব দিয়ে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমাতে আইনি সংস্কার করতে হবে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণে পুঁজিবাজার শক্তিশালী করা এবং সুশাসনের উন্নতি করতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতার জেরে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ।
করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কার পর দক্ষিণ এশিয়ায় নিত্যপণ্যের দাম একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছিল।
এর মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং পশ্চিমা অবরোধ বিশ্ব বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মত ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জানুয়ারিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। যদিও সরকারের এ হিসাব নিয়ে অর্থনীতিবিদদের অনেকের সংশয় আছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা করলেও গত অগাস্টের পর থেকে তা বাড়তির দিকে।
তবে মহামারির ধকল সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বাংলাদেশ দ্রুত যেসব কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, সেজন্য সরকারের প্রশংসা করেছে আইএমএফ।
করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কার পর দক্ষিণ এশিয়ায় নিত্যপণ্যের দাম একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছিল।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির সঙ্কট যখন শুরু হয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি তখন স্থিতশীল অবস্থাতেই ছিল। লকডাউনের মধ্যে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাজ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। সরকার তখন ২৮টি প্যাকেজের মাধ্যমে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, যা দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশের সমান।
পাশাপাশি কম গুরুত্বপূর্ণ খাতের দৈনন্দিন ব্যয় কমিয়ে আনা এবং দ্রুত দেশের অধিকাংশ মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বিষয়গুলোও উল্লেখ করা হয়েছে আইএমএফ এর প্রতিবেদনে।
আইএমএফের এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফর করেন। দুই সপ্তাহের ঐ সফরে তারা বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, অর্থ সচিব, এনবিআরের চেয়ারম্যানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে প্রসংশা করা হয়েছে। পাশাপাশি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব, করোনার অনিশ্চিত গতিপথ, ভ্যাকসিন কার্যক্রমে ধীরগতির বিষয়ে তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসংশা করে বলা হয়েছে, স্বাধীনতা লাভ করার পর ৫০ বছরে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারাবাহিকতায় দারিদ্র্য হারও কমে এসেছে। সেইসঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্হ্য খাতে সাধারণ মানুষের সুযোগ বেড়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তোরণের সুপারিশ অর্জন করেছে।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির হার স্হিতিশীল রয়েছে, জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো অবস্হায় রয়েছে। প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে নীতি কাঠামোগুলো রপ্তানি বৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি, মানবসম্পদে বিনিয়োগ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবহার করতে হবে।
করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠেতে খুব দ্রুত প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয় যা জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ। করোনার প্রভাব সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স আহরণ, রপ্তানি খাতে প্রণোদনা দেওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের উপরে হয়েছে। আইএমএফ এর পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
মূলত রপ্তানি আয়ে গতি, প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন, আর্থিক ও রাজস্ব নীতির বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে ধারণা করা হয়েছে।
সংস্থাটির হিসাবে এ বছর মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি দেশের বাজারেও চাপ থাকবে। করোনায় সরকারি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ বছর বাজেট ঘাটতি জিডিপির হিসাবে ৬ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয়ের হিসাব নিয়ে সরকারি অডিটের প্রশংসা করেছে আইএমএফ। সেইসঙ্গে বিলম্ব না করে এই অডিট প্রতিবেদন প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের আর্থিক নীতি গত কয়েক বছরে সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, জিডিপির তুলনায় ঋণের হারও তুলনামূলকভাবে কম রয়েছে।
আইএমএফের পূর্বাভাস বলছে, রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়ানোয় এ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রণোদনা তহবিলের বাস্তবায়ন এবং সঙ্কুলানমুখী মুদ্রানীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মহামারির শুরুর ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে, যা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হওয়ার হিসাব দেয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে। তবে বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে এবার বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৪
আপনার মতামত জানানঃ