২০২৪ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাটকীয় এক পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকার হঠাৎ এক সন্ধ্যায় ক্ষমতা ছাড়ে এবং শোনা যায়, তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন। তার ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা যায়, চরম রাজনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের কঠোর সমালোচনার মুখে তিনি কাতারে একটি ব্যক্তিগত বিমানে দেশ ত্যাগ করেন। এই ঘটনার পর দেশজুড়ে তৈরি হয় আলোড়ন, কিন্তু খুব দ্রুতই একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে আসেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বে একটি নবনির্বাচিত সরকার গঠিত হয় ২০২৫ সালের শুরুতে।
শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময় ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, মুদ্রাস্ফীতি এবং দুর্নীতির চাপে জর্জরিত। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, বৈদেশিক ঋণের দায় এবং বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতার সংকট দেশের অর্থনীতিকে তলানিতে ঠেলে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে নতুন সরকারের যাত্রা ছিল একদিকে সংকটে পূর্ণ, অন্যদিকে সম্ভাবনায় উদ্দীপ্ত।
নতুন সরকার প্রথমেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। পুরাতন আমলার জায়গায় তরুণ, শিক্ষিত এবং মেধাবী প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। ভূমি অফিস, কর ব্যবস্থা, ব্যাংকিং খাত ও শুল্ক বিভাগে প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কার আনা হয়। এর ফলে রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। পূর্বের তুলনায় আয়কর দাতা সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়ে যায় এবং ভ্যাট আদায়ে ডিজিটাল মনিটরিং চালু হওয়ায় ফাঁকি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে। ২০২৪ সালের শেষে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ইউনূস সরকারের সময় চালু হয় “ঋণ স্বচ্ছতা প্রোগ্রাম”, যার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল ও খরচ সাশ্রয় নিশ্চিত করা হয়। সেইসঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়িয়ে ঋণ পরিশোধের একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সরকার প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মজবুত করে।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় আসে আমূল পরিবর্তন। এলসি খোলার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির উপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয় এবং স্বর্ণ, বিলাসদ্রব্য ও অব্যবহৃত প্রযুক্তিপণ্যের উপর কর বাড়ানো হয়। এর ফলে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৭ বিলিয়ন ডলার, তা ২০২৫ সালের মে মাসে এসে দাঁড়ায় ২২.৩ বিলিয়ন ডলারে।
রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এনবিআরের আধুনিক সফটওয়্যার ও স্বয়ংক্রিয় কর ব্যবস্থাপনা চালু হওয়ার ফলে কর ফাঁকি কমে যায়। সরকারি তথ্য মতে, ২০২৫ সালের প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আদায় ৪ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও হুন্ডি রোধ ও সহজতর ব্যাংকিং চ্যানেল চালুর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধেই প্রবাসী আয় দাঁড়ায় ১২.৮ বিলিয়ন ডলারে।
সবচেয়ে লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে দুর্নীতির পরিমাপে। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২৩ সালে দুর্নীতির ধারণা সূচকে ১২৮তম অবস্থানে থাকলেও ২০২৫ সালের শুরুর দিকে উঠে আসে ১০২তম স্থানে। সরকারি ক্রয়-বিক্রয়, টেন্ডার এবং নিয়োগে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে চালু হয় “সততার পুরস্কার” নামের একটি প্রণোদনা ব্যবস্থা, যা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির প্রবণতা কমিয়ে আনে।
তবে এই সময়ের সব কিছুই যে মসৃণ তা নয়। একদিকে সরকার যখন দুর্নীতি দমন ও অর্থনৈতিক সংস্কারে ব্যস্ত, তখনই আন্তর্জাতিক বাজারে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। গার্মেন্টস খাতের অর্ডার কমে যাওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। সরকার বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য “গৃহভিত্তিক শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প” চালু করে, যার মাধ্যমে ৫ লক্ষ নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, তবে তা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।
শিল্প খাত বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার নিয়ন্ত্রণে আনা হলেও তাদের পুঁজির অভাব ও বাজারে প্রতিযোগিতার চাপে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ইউনূস সরকার কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে যেমন, স্বল্প সুদে মাইক্রোফিন্যান্স, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ এবং ই-কমার্সে প্রবেশে সহযোগিতা। তবে এসব পদক্ষেপের প্রভাব পূর্ণভাবে পড়তে সময় লাগবে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলেও সীমান্ত পরিস্থিতি এবং ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়েছে। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ও জলবণ্টন ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার গতি ধীর। তবে অর্থনৈতিক স্বার্থে উভয় দেশ কিছু যৌথ উদ্যোগ যেমন শিল্প পার্ক, রেললাইন সম্প্রসারণ ও বাণিজ্য চুক্তি বহাল রেখেছে। অপরদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। চীনা বিনিয়োগে পায়রা বন্দর, মেট্রোরেল এক্সটেনশন এবং ফাইভ-জি অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন মাত্রা পায়।
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বেশ ইতিবাচক হয়েছে। ইউনূস সরকারের স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারমূলক অবস্থানের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়েছে। ইউএসএআইডি, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারকে সমর্থন জানিয়ে ঋণ ও অনুদান বাড়িয়েছে। বিশেষ করে নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য স্টার্টআপ ফান্ড ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ড. ইউনূসের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে সামাজিক ব্যবসার ধারণা। সরকার শুধু উন্নয়ন নয়, সামাজিক বৈষম্য কমাতে সামাজিক ব্যবসার প্রকল্প যেমন “গাঁথুনির ঘর,” “নারী উদ্যোক্তা সঞ্চয় প্রকল্প” এবং “স্কুল থেকে শিল্প” কর্মসূচি চালু করে। এসব প্রকল্পে সরাসরি পুঁজিবিনিয়োগ না করে সরকার সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে জনগণের অংশগ্রহণ ও মালিকানা বাড়ছে এবং দারিদ্র্য নিরসনের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে রাজনীতিতে এখনো কিছু উদ্বেগ রয়ে গেছে। শেখ হাসিনার অনুসারী ও দলীয় নেতারা এখনো কিছু এলাকায় সক্রিয় এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চেষ্টা করছে। সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে থাকলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যাতে না ওঠে, সেদিকে সতর্কতা অবলম্বন করছে। নির্বাচন কমিশনও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নিয়মিত সংলাপে বসছে যাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।
এই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন পথে হাঁটছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের পর একটি নতুন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার উদ্ভব হয়েছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা, বৈদেশিক ঋণ হ্রাস, রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার—সব মিলিয়ে অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে এই অগ্রযাত্রা টিকিয়ে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, রাজনৈতিক ঐক্য এবং নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ছাড়া বিকল্প নেই। সময়ই বলে দেবে বাংলাদেশ এই নবযাত্রার কতটা সুফল ভোগ করতে পারবে।
আপনার মতামত জানানঃ