নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সুরক্ষা দিতে গত এক বছরে বাংলাদেশে বড় কোনো আইনি সংস্কার করা হয়নি। ফলে কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর আইনি সুরক্ষা পাওয়ায় বিশ্বের তলানির দেশগুলোর একটিই রয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে মাত্র আফগানিস্তান। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় মাত্র অর্ধেক আইনি সুরক্ষা পান এ দেশের নারীরা।
বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪তম, যা গত বছর ছিল ১৭১তম। দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম।
বিশ্বব্যাংকের ‘ওমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২২’ শীর্ষক সূচকে এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার রাতে ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত হয়। এতে বিশ্বের ১৯০টি দেশের নারীর কর্মক্ষেত্র ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আইনি সুরক্ষার চিত্র তুলে ধরা হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে এটি প্রকাশ করা হয়েছে।
আটটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। এগুলো হলো কাজের জন্য বিচরণ-সুবিধা; কর্মপরিবেশ; বেতন-মজুরি; বিবাহ; অভিভাবকত্ব; উদ্যোক্তা; সম্পদ ও সরকারি ভাতা। এই আট সূচকের মধ্যে কাজ খোঁজার সূচকে বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের আইনি সমতা আছে। কাজ খুঁজতে নারীদের কোনো বাধা নেই। বাকি কোনো সূচকেই নারী-পুরুষের আইনি সমতা নেই।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বেতন-মজুরি ও ভাতাসুবিধা এবং সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে। বেতন-মজুরি এবং কর্মকালীন ও অবসরকালীন ভাতা পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় ৪ ভাগের ১ ভাগ আইনি সুরক্ষা পান। এই দুর্বলতায় ওই দুটি সূচকে বৈষম্য সবচেয়ে বেশি। তারা আইনি প্রতিকার কম পান। সার্বিকভাবে সূচকে বাংলাদেশ নারী-পুরুষের আইনি সুরক্ষায় ৪৯ দশমিক ৪ পয়েন্ট পেয়েছে। এর মানে হলো, সমান অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় অর্ধেকের কম আইনি সুরক্ষা পান না। এবারের সূচকে বৈশ্বিক ও দক্ষিণ এশিয়ায় গড় স্কোর যথাক্রমে ৭৬ দশমিক ১ ও ৬৩ দশমিক ৭। বাংলাদেশে দুটোতেই কাঙ্ক্ষিত মানের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নারীর চলাচলের স্বাধীনতায় বাংলাদেশের স্কোর ১০০, কর্মক্ষেত্রে ৫০, কাজ করার জন্য বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে ২৫, ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ৭৫, সম্পত্তির অধিকারে ৪০, বিয়ে করা ৬০, সন্তান নেয়া ২০ এবং পেনশন পাওয়ার ক্ষেত্রে স্কোর ২৫।
কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশে শক্তিশালী আইন নেই। ফলে ঘরের বাইরে এসে নারীরা কাজ করতে নিরাপদ বোধ করেন না।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৯০ স্কোর নিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে নেপাল। দেশটির অবস্থান ৯০তম। এছাড়া ভারতের অবস্থান ১২০ (স্কোর ৭৪.৪), মালদ্বীপ ১২২ (স্কোর ৭৩.৮), ভুটান ১২৭ (স্কোর ৭১.৯), শ্রীলংকা ১৪৩ (স্কোর ৬৫.৬), পাকিস্তান ১৬৭ (স্কোর ৫৫.৬) এবং আফগানিস্তান ১৮৪ (স্কোর ৩৮.১)। প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়, এ অঞ্চল বিশ্বের অন্য অঞ্চলের চেয়ে তুলনামূলক বেশি এগিয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধে আইন করেছে। মালদ্বীপ কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির প্রতিকারের ব্যবস্থা করেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশে শক্তিশালী আইন নেই। ফলে ঘরের বাইরে এসে নারীরা কাজ করতে নিরাপদ বোধ করেন না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কোনো আইন করা হয়নি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ১২টি দেশে নারী-পুরুষের আইনি সুরক্ষা সমান।
এগুলো হচ্ছে-বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, গ্রিস, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, লাটভিয়া, লুক্সেমবার্গ, পর্তুগাল, স্পেন ও সুইডেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বে পুরুষরা যেসব আইনি সুরক্ষা পায়, নারীরা তার চার ভাগের তিন ভাগ পায়। এ বৈষম্য নারীর চাকরি প্রাপ্তি, ব্যবসা পরিচালনা ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে বাধা। এখনো বিশ্বের ২৪০ কোটি নারী-পুরুষের মতো সমান পছন্দের কর্মসংস্থানে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি বাধার মুখে।
কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে৷ ২০০৯ সালে হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধে নির্দেশনা দেয়৷ তাতে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে৷ অভিযোগ দেয়ার ব্যবস্থা এবং তার নিস্পত্তির ব্যবস্থার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়৷ কিন্তু তা অনুসরণ করছেনা প্রতিষ্ঠানগুলো৷ অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ওই কমিটির ব্যাপারেই জানেনা৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা নিরোধ করতে নানা ধরনের আইন আছে৷ হাইকোর্টের রায়ও আছে৷ কিন্তু রাষ্ট্র বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সেটা নেওয়া হচ্ছে না৷ এই ধরনের হয়রানির শিকার হলে অনেকেই বলতে পারে না৷ তার চাকরির ভয় থাকে বা তাকে নিয়ে কথা বলাবলির একটা ভয় কাজ করে৷
তারা বলেন, আইন যা আছে তার যদি সঠিক প্রয়োগ হতো তাহলেও অনেক সমস্যা কমে যেত৷ আইনকানুনের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন৷ যেটা বলছিলাম, যৌন নিপীড়ন৷ সেখানে আদালতের একটা রায় আছে৷ সেখানে বলা আছে, একটা ঘটনা ঘটলে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না৷ আইনে কিন্তু বলা আছে, আপনি একজন পুরুষ হলে কর্মক্ষেত্রে আপনি একজন নারীর সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করবেন, কী করলে অশ্রদ্ধা হিসেবে গণ্য হবে তাও বলা আছে৷ এগুলো কিন্তু মানা হচ্ছে না৷
তারা বলেন, সুপ্রিমকোর্টের একটা রায় আছে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একটা সেল থাকতে হবে৷ এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এসব কমিটিতে অবশ্যই নারীদের সংখ্যা বেশি থাকতে হবে৷ সেখানে যে কেউ অভিযোগ করতে পারবে৷ কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই সেটার বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ কিন্তু তেমনটি হচ্ছে কোথায়!
তারা বলেন, একটা ভালো দিক, কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে৷ তারা এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছেন৷ এই উদ্যোগগুলো আরো বেশি জোরালো করা দরকার৷ তারা মনে করেন, কেন্দ্রীয়ভাবে এটা পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন৷ আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, যে প্রতিষ্ঠান থেকে এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হোক, বা ব্যবস্থা নেওয়া হোক প্রতিবেদনগুলো সংসদে যেতে হবে৷ কিন্তু সংসদে কোনো প্রতিবেদন যাচ্ছে বলে আমরা জানি না৷ এটা নিয়ে কোনো পর্যালোচনাও আমরা শুনিনি৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বিশেষ করে বাংলাদেশের নারীরা অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন বেশি। ফলে বেতন থেকে শুরু করে সব ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাদের। শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ঠিক কিন্তু শিক্ষিত নারীদের অংশগ্রহণ খুব একটা বাড়েনি। অল্পশিক্ষিত নারীরা ছোট ছোট পদে কাজ করে। এসব পদের নারী শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বৈষম্য করতে পারে। এক্ষেত্রে নারীদের শিক্ষা এবং দক্ষতা দুটোই বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪২
আপনার মতামত জানানঃ