অস্ট্রেলিয়া একটি অনন্য মহাদেশ, যার প্রত্যেকটির নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিস্থিতি, প্রাণীজ উদ্ভিদ এবং উদ্ভিদ রয়েছে: মরুভূমি, সমুদ্র উপকূল, গ্রীষ্মমন্ডলীয় বন, পর্বতশৃঙ্গ। অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ প্রাণী স্থানীয় অঞ্চলে থাকে এবং তার অঞ্চলে একচেটিয়া বসবাস করে। এটি বহু সহস্রাব্দের জন্য মূল ভূখণ্ডটি দেশের অন্যান্য অংশ থেকে পৃথকভাবে ছিল বলে এই কারণে হয়েছিল।
বিবর্তনের ইতিহাসের দুর্লভ একটি রত্ন উঠে এল অস্ট্রেলিয়ার খনি থেকে। হদিশ মিলল এমন একটি প্রাণীর যার পায়ের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। পৃথিবীতে এর আগে এতগুলি পায়ের কোনও প্রাণীর আবিষ্কার হয়নি। তাই সদ্য আবিষ্কৃত প্রাণীটিকে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘বিবর্তনের ইতিহাসের দুর্লভ একটি রত্ন।’ খবর আনন্দবাজার, সংবাদ প্রতিদিন
সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’-এ।
প্রাণীটিকে বলা হচ্ছে ‘বিবর্তনের বিস্ময়’। মাটির ৬০ মিটার গভীরে ঘোর অন্ধকারের মধ্যে বাস করে সে। এই খুদে প্রাণীটিকে দেখে বিস্ময়ের ঘোর আর কাটছে না বিজ্ঞানীদের। কেন? আসলে বড়জোর ৩ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এই প্রাণীটির পায়ের সংখ্যা ১ হাজার ৩০৬! পৃথিবীতে কোনও প্রাণীরই এতগুলি পা নেই। স্বভাবতই এই প্রাণীকে ঘিরে বাড়ছে উত্তেজনা।
সন্ধিপদী অর্থাৎ আর্থ্রোপোডা (arthropods) এই প্রাণীটি মিলিপেড গোত্রের। এই শব্দটির অর্থ হাজার পা হলেও এতদিন পর্যন্ত এই গোত্রের প্রাণীদের মধ্যে সর্বোচ্চ পায়ের সংখ্যা ইলাকমে প্লেনিপসের। তাদের পায়ের সংখ্যা ৭৫০। কিন্তু ইউমিলিপস পার্সেফোন নামের এই নয়া আবিষ্কৃত প্রাণীটির পায়ের সংখ্যা ১ হাজারকেও ছাপিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু কেন এদের পায়ের সংখ্যা এত বেশি? গবেষকদের মতে, মাটির নিচে সূক্ষ্ম ফাটলের ভিতর দিয়ে যেতে গেলে এতগুলি পায়ের সাহায্যেই ধাক্কা মেরে পথ করে এগিয়ে চলা যায়। তাই বিবর্তনের ফলেই ক্রমশ বেড়েছে পায়ের সংখ্যা।
মৃত এমন ৪টি প্রাণীর হদিশ মিলেছে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ‘গোল্ডফিল্ডস-এসপের্যান্স রিজিওন’-এ। তাদের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছে আরও চারটি প্রায় একই প্রজাতির প্রাণী। মৃত অবস্থায়। তাদের পায়ের সংখ্যা যদিও অতগুলি নয়।
যেখানে এদের সন্ধান মিলেছে সেই এলাকায় রয়েছে প্রচুর সোনার খনি। রয়েছে আরও বহু আকরিকের খনিও। যাদের মধ্যে রয়েছে লিথিয়াম ও ভ্যানাডিয়ামের মতো খুব দুর্লভ খনিজও।
এই দুর্লভ প্রাণীর হদিশ মিলেছে একটি সোনার খনিতে। সোনা তোলার সময়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রাণীটি আদতে বহু পদের কেন্নো। এরা যে পরিবারের সদস্য তারা পৃথিবীতে এসেছিল ৪০ কোটি বছর আগে। সুতোর মতো দেখতে ধূসর রঙের কেন্নো। দৈর্ঘ্যে সাড়ে তিন ইঞ্চি। চওড়ায় এক ইঞ্চির চারশো ভাগের এক ভাগ। তিনকোণা মাথা। মুখটা বকের ঠোঁটের মতো। শুঁড়গুলি খুব বড়। কোনও চোখ নেই। শুঁড়গুলি দিয়েই তারা এলাকা চিনত বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
প্রাণীটিকে বলা হচ্ছে ‘বিবর্তনের বিস্ময়’। মাটির ৬০ মিটার গভীরে ঘোর অন্ধকারের মধ্যে বাস করে সে। এই খুদে প্রাণীটিকে দেখে বিস্ময়ের ঘোর আর কাটছে না বিজ্ঞানীদের। কেন? আসলে বড়জোর ৩ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এই প্রাণীটির পায়ের সংখ্যা ১ হাজার ৩০৬! পৃথিবীতে কোনও প্রাণীরই এতগুলি পা নেই। স্বভাবতই এই প্রাণীকে ঘিরে বাড়ছে উত্তেজনা।
এর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় যে কেন্নোর আবিষ্কার হয়েছিল তার পায়ের সংখ্যাই প্রাণীজগতে এত দিন ছিল সবচেয়ে বেশি। ৭৫০টি। কেন্নোর সেই প্রজাতির নাম— ‘ইলাক্মে প্লেনিপেস’।
গবেষকরা জানিয়েছেন সদ্য আবিষ্কৃত প্রাণীরা যে প্রজাতির কেন্নো জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় তাদের নাম— ‘ইউমিলিপেস পারসেফোরি’। এরা মাটির ২০০ ফুট নীচেও দিব্য থাকতে পারত। এই কেন্নোর স্ত্রীদের পায়ের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে বেশি।
গবেষণাপত্রটির অন্যতম লেখক পল মারেক জানাচ্ছেন, স্ত্রী প্রাণীগুলির পায়ের সংখ্যা পুরুষদের থেকেও বেশি। তাদের মতে, এই প্রাণীটি সত্যিই ‘বিবর্তনের বিস্ময়’। অন্ধকারের বাসিন্দা এই প্রাণীগুলির দৃষ্টিশক্তি নেই। জন্মগত ভাবেই এরা অন্ধ। তাই স্পর্শ ও গন্ধকে সম্বল করেই শঙ্কু আকৃতির মাথা ও চঞ্চু-সদৃশ মুখের এই সন্ধিপদীরা পথ চলে। অস্ট্রেলিয়ার যেখানে এদের সন্ধান মিলেছে সেটি খাদান এলাকা। মাটির গভীরে লোহা ও আগ্নেয় পাথর রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এই ধরনের পরিবেশই হয়তো এদের বসবাসের জন্য অনুকূল পরিবেশ।
আর্থ্রোপোডারাই হল প্রথম প্রাণী যারা জমির দখল নিয়েছিল। নতুন আবিষ্কৃত এই প্রাণীটি মাটির অনেক গভীরে বাস করে। যা এক বিস্ময়। এদের ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলে আরও নানা অজানা তথ্য জানা যাবে বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের পর হোমো স্যাপিয়েন্সরা প্রযুক্তি ও সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বসতি গড়ার দূরদর্শিতা অর্জন করে। এর আগে শুধু তারা আফ্রো-এশিয়ার স্থলভূমিতেই বাস করত। বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের আগ পর্যন্ত সাঁতার কেটে বা ভেলা বানিয়ে স্বল্প দূরত্বের দ্বীপে নিজেদের পদচিহ্ন রেখে যেতে পারলেও, তখনো তারা বিস্তীর্ণ জলরাশির খোলা সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করে উঠেনি। তাই, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মাদাগাস্কার, নিউজিল্যান্ড বা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ ছিল তখনো হোমো স্যাপিয়েন্সদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের পর সহসা পালটে যায় সে চিত্রপট। আজ থেকে প্রায় ৪৫ হাজার বছর পূর্বে মানবজাতি অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে সফলতার মাইলফলক স্থাপন করে। স্যাপিয়েন্সদের এই সাফল্যগাথার সুনিপুণ বিবরণ দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিস্তর বেগ পোহাতে হচ্ছে। কারণ, অস্ট্রেলিয়াতে পদার্পণ করতে গিয়ে স্যাপিয়েন্সদের বহু সামুদ্রিক প্রণালী পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রণালীর প্রস্থ ছিল শতাধিক কিলোমিটারেরও বেশি।
বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তথ্যানুসারে, ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী স্যাপিয়েন্সদের মধ্যেই সর্বপ্রথম সমুদ্রচারী সমাজের উদ্ভব ঘটে। তাদের সমুদ্র বিষয়ক জ্ঞান ও দক্ষতায়ই তাদের দূরপাল্লার জেলে, বণিক, কিংবা দূরপাল্লার অভিযাত্রী হিসেবে গড়ে তুলেছিল। সেই বিদ্যা ও দক্ষতার কাঁধে ভর দিয়েই তারা অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল।
হোমো স্যাপিয়েন্সদের এই সাহসী পদক্ষেপ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। কারণ, মানুষ তখন শুধু তাদের চিরপরিচিত আফ্রো-এশিয়ার বাস্তুসংস্থান ছেড়েই আসেনি, বরং বড় আকারের কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর পক্ষে হাজার হাজার ক্রোশ জলপথ পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা রাখার প্রথম দৃষ্টান্ত ছিল সেটাই।
অস্ট্রেলিয়ার বালুময় সমুদ্রতীরে মানুষের প্রথম পদচিহ্ন পড়ার পরেই মানুষ সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এক বাস্তুসংস্থানের দেখা পায়, যা তাদের জন্য একেবারে নতুনই বলা চলে। বিস্তীর্ণ বেলাভূমি ছেড়ে মানুষ যত সামনের দিকে এগোতে থাকে, ততই তারা মুখোমুখি হতে থাকে অজানা সকল প্রাণীর। সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত এই মহাদেশের আকাশে উড়ে বেড়ানো পক্ষীকুল আর বুকে ভর দিয়ে হাঁটা সরীসৃপেরা বাদে বাকি প্রায় সব প্রাণীই ছিল ক্যাঙ্গারুর মতো মারসুপিয়াল।
অস্ট্রেলিয়াতে এখনো বিভিন্ন বিরল প্রাণীর সন্ধান মেলে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ