অডিও কেলেঙ্কারির অভিযোগে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার পর মুরাদ হাসান কানাডার উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সূত্র মতে, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের দু’দিন পর আজ শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) কানাডার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন ডা. মুরাদ হাসান। এদিকে, গত ৭ ডিসেম্বর শাহবাগ থানায় অভিযোগ করা হয়, চলছিল তদন্ত। এর মধ্যে মুরাদ হাসানের দেশ ত্যাগ এবং এ নিয়ে সরকারের উদাসিনতা কি কোনও প্রশ্ন তৈরি করবে না! পদত্যাগের পর দেশত্যাগ, স্ক্রিপ্টের সফল মঞ্চায়ন যেন।
যেভাবে দেশ ছাড়লেন ডা. মুরাদ
বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) রাত ১১টা ২০ মিনিটে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে তার ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল। তবে বিলম্বের কারণে রাত ১টায় ফ্লাইটটি ছাড়ে বলে জানিয়েছেন ইমিগ্রেশনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
এমিরেটসের ইকে-৮৫৮৫ ফ্লাইটে মুরাদ প্রথমে দুবাইতে ট্রানজিট হয়ে তারপর কানাডার টরন্টোতে যাবেন। ট্রানজিট হওয়ায় দুবাইগামী যাত্রীদের করোনা টেস্টের ফল পরীক্ষা করতে সময়ক্ষেপণ হয়। ফলে ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের চাপে ফ্লাইটটির ঢাকা ছাড়তে বিলম্ব হয়।
দেশ ছাড়ার সময় মুরাদ হাসানের পরনে কালো রঙের ব্লেজার, টি–শার্ট, কালো মাস্ক, মাথায় কালো ক্যাপ ও জিনস প্যান্ট ছিল। বিমানবন্দরে মুরাদকে একাই দেখা গেছে।
ইমিগ্রেশন সূত্র বলছে, মুরাদকে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা হয়েছিল। কর্মকর্তারা তাকে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় শেষ পর্যন্ত কর্মকর্তারা তাকে ছেড়ে দেন।
গতকাল রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দরে আসেন মুরাদ। সেখানে রজনীগন্ধা লাউঞ্জে অপেক্ষমাণ ছিলেন তিনি। পদ হারানোর পর থেকে দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি গণমাধ্যম এড়িয়ে চলেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, মুরাদ হাসান বিদেশে যেতে চাইলে সরকার বাধা দেবে না। তিনি বলেন, ‘মুরাদ হাসান বিদেশে যাবেন কিনা সেটা তার সিদ্ধান্ত। এখানে আমাদের কিছু করার নাই।’
গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন অশ্লীল ও বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য আলোচনায় ছিলেন মুরাদ। সম্প্রতি বিএনপি নেতা তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে ডা. মুরাদ হাসানের দেওয়া ‘অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ’ বক্তব্যের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়।
এরপর গত রোববার রাতে ফাঁস হয় ঢাকাই সিনেমার একজন নায়িকাকে ‘ধর্ষণ’ এর হুমকি দেওয়ার একটি অডিও ক্লিপ। এর মধ্যে আরেকটি অনলাইন টকশোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নারী নেত্রীদের নিয়েও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিতে দেখা যায় প্রতিমন্ত্রী মুরাদকে।
তার এসব বক্তব্যের সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছিলেন নারী অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। খোদ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্য থেকেও মুরাদ হাসানকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবিও উঠেছিল।
এসব বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য গত ৬ ডিসেম্বর ডা. মুরাদ হাসানকে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। পরদিন ৭ ডিসেম্বর ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন মুরাদ।
এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের এক জরুরি সভায় মুরাদ হাসানকে জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় বুধবার তাকে সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পদত্যাগের পর একটি ফেসবুক পোস্টে নারীদের উদ্দেশে ক্ষমা চান তিনি। সেখানে লেখেন, “আমি যদি কোন ভুল করে থাকি অথবা আমার কথায় মা-বোনদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।”
শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা জানিয়ে মুরাদ ফেসবুকে লেখেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী মা দেশরত্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সকল সিদ্ধান্ত মেনে নিবো আজীবন।”
মুরাদ হাসান নবম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে জামালপুর-৪ সংসদীয় আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৪ সংসদীয় আসন থেকে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হন। ২০১৯ সালের ১৯ মে থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন তিনি।
জামালপুর জিলা স্কুল, নটরডেম কলেজ এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন মুরাদ হাসান। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্সারবিজ্ঞান বিভাগে কনসালটেন্ট (পরামর্শক) হিসেবে কর্মরত আছেন।
থানায় অভিযোগ, চলছে তদন্ত
ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। এই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তও শুরু করে পুলিশ। শাহবাগ থানার ওসি মওদুদ হাওলাদার বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা জিডি করেছি। এরপর এটি সাইবার ক্রাইম বিভাগে পাঠানো হবে। এর মধ্যেই কানাডায় পাড়ি জমালেন মুরাদ হাসান।
ওসি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে হেয় করে বক্তব্য দিয়েছিলেন মুরাদ। এ ঘটনায় জুলিয়াস সিজার তালুকদার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান নাহিদ রেইনস পিকচার্স নামে একটি ফেসবুক পেইজে লাইভ অনুষ্ঠানে এসে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এই বক্তব্যকে ‘বিকৃত যৌনাচার ও বিদ্বেষমূলক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সিজার তালুকদার।
সিজারের অভিযোগ, ‘মুরাদ হাসান দেশের সর্বপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাচ্ছিল্য করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলের নারী শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননের অপচেষ্টা করেছেন।’
মুরাদ হাসানের বক্তব্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিও তীব্র অশ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সিজার।
তিনি লিখেছেন, ‘বিদ্যাপীঠসমূহের প্রতি তীব্র অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় কায়দায় ঘৃণার রাজনীতি করার অপপ্রয়াস দেখিয়েছেন। অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারমূলক বক্তব্য দিয়ে তাদের চরিত্র হননের অপচেষ্টা করেছেন, তিনি নারীর রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেন। মুরাদ হাসানের এই বক্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামাজিকভাবে মানক্ষুণ্ন করেছে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ