বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান এবং তার ভাইদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আল জাজিরার প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ দীর্ঘ অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র বিভাগে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ ডিআইজি পুরস্কার জিতেছে। বিশ্বের নামকরা সব সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা করে এ পুরস্কার জিতেছে আল জাজিরার এই তথ্যচিত্র। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া অন্যান্য তথ্যচিত্রের মধ্যে ছিল বিবিসি নির্মিত ‘দ্য বেইবি স্টিলার’। পুরস্কার দেয়া হয় গত ৩ অক্টোবর। খবর নেত্রনিউজ
মূল তথ্যচিত্র ছাড়াও এর নির্মাণ প্রক্রিয়া ও ভেতরের গল্প নিয়ে যে পডকাস্ট প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিও পুরস্কৃত হয়।
পুরস্কার প্রদানকারী সংগঠন ডিআইজির নামের পূর্ণাঙ্গ রূপ ‘দকুমেনতারি, ইনচ্যাইস্তে, জোরনালিজমি’ (তথ্যচিত্র, অনুসন্ধান, সাংবাদিকতা)। ডিআইজি ২০১৫ সাল থেকে একটি পদক প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। সংস্থাটি উঁচু মানের অনুসন্ধান ও প্রতিবেদন তৈরিতে নিযুক্ত সাংবাদিকদের দক্ষতা বিচারের একটি মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত সপ্তাহে দেয়া এই পুরস্কারে ডিআইজি বিচারকেরা বলেন, এখানে অবিশ্বাস্য দুর্নীতির চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। এই তথ্যচিত্র দর্শককে একদম ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়, যেখানে ক্ষমতার নগ্ন অপব্যবহারগুলো ঘটেছে। সংগঠিত অপরাধ সম্পর্কে গোপন তথ্য ফাঁসকারী সাহসী এক ব্যক্তির সুবাদে এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা দলের সুদক্ষ অনুসন্ধানে অপরাধে জড়িত রাঘব-বোয়ালদের খোঁজ বেরিয়ে আসে। আমরা দেখতে পাই, রাষ্ট্রটি কিভাবে সুসংগঠিত অপরাধ ও দুর্নীতিতে ডুবে গেছে। এই অনন্যসাধারণ অনুসন্ধান বাংলাদেশে তীব্র আলোড়ন তৈরি করে এবং সর্বোচ্চ স্তরের ক্ষমতাশালীদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করে।
ডিআইজি আরও মন্তব্য করে, এই তথ্যচিত্রে দেখান হয়েছে কিভাবে সংগঠিত অপরাধ পরিচালনাকারী একটি পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত থেকে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে পুরো রাষ্ট্রকে কবজা করে রেখেছে।
পডকাস্ট সম্পর্কে বলা হয়, ‘অনুসন্ধান কাজের বিভিন্ন আকর্ষণীয় দিক, ঘটনার গভীরে যাবার সাহসিকতা, পটভূমি বর্ণনার যে সুউচ্চ মান এবং এর চমৎকার শব্দ ধারণ ও সম্পাদনা— তা [পডকাস্টে] উঠে এসেছে।
একটি বিবৃতিতে আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (এজেআই) জানায়, ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ এই পুরস্কার পাওয়ায় তারা অত্যন্ত আনন্দিত। তথ্যচিত্র নির্মাতারা উল্লেখ করেন, এই পুরস্কারের মধ্যদিয়ে আন্তর্জাতিক বিচারকমণ্ডলী বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে, যেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চরমভাবে সীমিত এবং মানবাধিকার ভায়াবহ অবস্থায় আছে, সেখানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে এজেআই [অপরাধের] তথ্য ফাঁসকারী ব্যক্তিদের সাহসিকতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চায়; কারণ তারা এই অনুসন্ধানে অনেক বেশি অবদান রেখেছেন।
এই তথ্যচিত্রে দেখান হয়েছে কিভাবে সংগঠিত অপরাধ পরিচালনাকারী একটি পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত থেকে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে পুরো রাষ্ট্রকে কবজা করে রেখেছে।
আল জাজিরার প্রায় এক ঘণ্টার এই প্রতিবেদনে মূলত বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং তার তিন ভাই-এর কার্যক্রম দেখানো হয়েছে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের আপন তিন ভাই ২০০৪ সালে একটি হত্যাকাণ্ডের অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হয়েছিল। এই ভাইদের মধ্যে আনিস আহমেদ এবং হারিস আহমেদ বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
তৃতীয় ভাই, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ, যিনি হত্যার অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন।
যদিও দুই ভাই হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদ পলাতক, কিন্তু আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদকে জেনারেল আজিজ আহমেদের ছেলের বিয়েতে বাংলাদেশে দেখা গেছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয় আনিস আহমেদ থাকেন কুয়ালালামপুরে আর হারিস আহমেদ আছেন হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে।
প্রতিবেদনে গোপন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে বুদাপেস্ট-এ হারিস আহমেদের ব্যবসায়িক কার্যকলাপ নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। তিনি নাম পরিবর্তন করে হাসান মোহাম্মদ নাম নিয়ে বিভিন্ন দেশে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন সেটা দেখানো হয়েছে।
বুদাপেস্টে একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সাথে এক কথোপকথনে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য বুলেট সরবরাহের কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।
আল জাজিরার ঐ প্রতিবেদনে হারিস আহমেদকে বলতে শোনা গেছে পুলিশের চাকরি, যেমন থানার ওসির পদ, পেতে কত টাকা নেয়া হয় । তিনি সেখানে বলছেন, এক্ষেত্রে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। এই কাজে সরকারের শীর্ষ স্থানের লোক জড়িত থাকেন বলে হারিস আহমেদ উল্লেখ করেন।
এছাড়া র্যাবকে ইচ্ছামাফিক নিজের কাজে ব্যবহারের কথাও বলতে শোনা যায় হারিসকে: ‘আমার গুন্ডা অইলো অহন র্যাব। আমার আর গুন্ডা লাগে না, আমার তো এইডিই গুন্ডা। কাউরে উডাই লইয়া আও, কাউরে ধরো…ওরাও খায়, আমিও খাই। ডাইরেক্ট কথা!’ র্যাবকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী সেলিম প্রধানের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করেছেন এবং তাকে গ্রেপ্তার করিয়েছেন, তা নিয়েও হারিসকে দম্ভোক্তি করতে শোনা যায় আল জাজিরার এই তথ্যচিত্রে।
এছাড়া, নিরাপত্তা বাহিনী ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন নজরদারি করার প্রযুক্তি ইসরায়েল থেকে আমদানি করেছে এমন কিছু নথিপত্র দেখানো হয়েছে। তবে এই ক্রয়ের সাথে হারিস আহমেদের কোন যোগাযোগের কথা এই প্রতিবেদনে বলা হয়নি।
তথ্যচিত্রটি প্রচারের পর বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিক্রিয়ায় বলে: ‘এই প্রতিবেদন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ‘কুৎসা রটনার’ একটি প্রচার অভিযান বলেই প্রতীয়মান। এটি তৈরির পেছনে রয়েছে চরমপন্থী গোষ্ঠী, ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জড়িত একদল কুখ্যাত ব্যক্তি এবং এখানে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কিছু পরোক্ষ ইঙ্গিতপূর্ণ কথা ছাড়া আর কিছুই নেই’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আল জাজিরার প্রতিবেদনের পর যাদের তদন্ত করার কথা, তারাও তা না করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ যাদের প্রশ্ন তোলার কথা তারাও প্রতিবাদই করেছেন৷ কেউ কোনো প্রতিবেদন করলেই যদি তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণ শুরু হয়, তাহলে প্রশ্নটা তুলবে কে? দেশের আইনের শাসন ও নৈতিকতার ওপর মনে হয় এত বড় আঘাত এর আগে কখনো আসেনি। একজন সেনাপ্রধান নিয়োগে এতটাই এবং এতটাই বেপরোয়া মনোভাব দেখানোর ভয়ানক পরিণতি! দেশটার ন্যুনতম নৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ