সেনাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সদ্যবিদায়ী জেনারেল আজিজ আহমেদ। ওই প্রতিবেদনে তার এবং তার ভাইদের বিষয়ে বিভিন্ন বিতর্কিত তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। গতকাল শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে ‘খালেদ মহিউদ্দিন জানতে চায়’ শীর্ষক ইউটিউব টকশোতে সেসব বিতর্কিত প্রসঙ্গে মুখ খোলেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। এক ঘণ্টার ওই আলোচনায় কথা বলেছেন তাকে নিয়ে উঠে আসা নানা অভিযোগের বিষয়ে৷
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রচারিত তথ্যচিত্রের কারণে বিব্রত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি বলেছেন, আগামী ২৫ জুন সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে তার অবসর শুরু হলে এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেবেন তিনি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিলের খবরটি নাকচ করে দিয়ে সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেছেন তিনি নিজেও এ খবরটি গণমাধ্যমে শুনেছেন। তার জানামতে, তার বৈধ ভিসা আছে।
সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ দাবি করেছেন, ভাইদের পরিচয়পত্র ও অন্যান্য কাগজে তথ্য পরিবর্তনে কোনো প্রভাব খাটাননি তিনি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তিনি।
ডয়চে ভেলেকে সাক্ষাৎকারে তিনি আলজাজিরার তথ্যচিত্র, ভাইদের বিষয়ে নানা অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা বাতিল, নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।
সম্প্র্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, সাবেক এই সেনাপ্রধানের ভিসা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে জেনারেল আজিজ সরাসরি তা অস্বীকার করেন। জানান, তিনিও গণমাধ্যমে এ সংবাদ শুনেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কারও ভিসা বাতিল করলে তাকে তা জানানোর বিধান আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেশটির কোনো দায়িত্বশীল দপ্তরের কাছ থেকে পাননি। গণমাধ্যমগুলো যথাযথ সূত্র ও তথ্যপ্রমাণ উল্লেখ না করেই এ বিষয়ে প্রতিবেদন ছাপিয়েছে বলে তার অভিযোগ। এই মুহূর্তে তার বৈধ ভিসা আছে কিনা—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি—আছে।’
‘আমি চ্যালেঞ্জ করছি, কেউ যদি কোনো একটা ‘এভিডেন্স’ দিতে পারে যে আমি বিজিবিতে থাকাকালে, আমি সেনাপ্রধান থাকাকালে আমার কোনো ভাই বা আত্মীয়কে বিজিবি বা সেনাবাহিনীর কোনো ‘আর্মস, ইকুইপমেন্ট, অ্যামুনিশান প্রকিউরমেন্ট, কন্ট্রাক্ট’ দিয়েছি—এটা যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে ‘আই উইল অ্যাকসেপ্ট এনিথিং। আই অ্যাম রেডি। আই অ্যাম গিভিং এ চ্যালেঞ্জ’।
তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক কিনা—এমন প্রশ্ন করলে আজিজ আহমেদ বলেন, ‘কয়েকশ কোটি নয়, আমাকে সামান্য কিছুর সূত্র দিন, যাতে বাকি জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারি। শত শত কোটি নয় যদি… বলতে পারেন লক্ষ লক্ষ বা এক-দুই কোটি টাকা আছে তাহলে ওটা দিয়ে আমি পরিকল্পনা করব আমার ভবিষ্যৎটা স্বচ্ছন্দ হতে পারে কিনা।’
তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ মনগড়া হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। অবসর জীবন নিয়ে তিনি বলেন, রিটায়ারমেন্টের পরে তিনি এখন দায়িত্বের চাপ থেকে মুক্ত। এই মুহূর্তে পোস্ট ডক্টরাল করছেন তিনি। সে বিষয়ে গবেষণা করেই সময় কাটাচ্ছেন।
সেনাপ্রধানের দায়িত্ব ছাড়ার পরপরই তার ব্যক্তিগত সহকারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় বলে খবর বের হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশে এই ১৬তম সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, আমি যখন রিটায়ারমেন্টে আসি তখন শুনেছি, সে অবসরে গিয়েছে। ডিসিপ্লিন বলে একটা কথা আছে। দুর্নীতির বিষয়টি আরও গভীর। অত সিরিয়াস যদি কোনোকিছু হতো, ‘হি শুড হ্যাভ বিন ডিসক্লোজড ফ্রম দ্য সার্ভিস।’ সে ক্ষেত্রে আমরা অনেককে জেল দিয়ে থাকি, অনেককে বরখাস্ত করে থাকি। ‘হি ওয়াজ গিভেন নরমাল রিটায়ারমেন্ট।’ আমি এই ব্যাপারে ‘ফারদার’ কিছু বলতে চাচ্ছি না।”
গত ফেব্রয়ারি মাসে এই সেনাপ্রধান ও তার ভাইদের নিয়ে একটি অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র প্রকাশ করে আলজাজিরা। এ নিয়ে তখন তোলপাড় হয় বাংলাদেশে। এই তথ্যচিত্র প্রকাশের পর শুরুতে বিব্রত হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন আজিজ আহমেদ। সেই সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকলেও সেখানে এর কোনো প্রভাব পড়েনি বলে দাবি করেন।
তথ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছিল, ইসরায়েল থেকে স্পাইওয়্যার ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ক্রয় প্রক্রিয়ায় জেনারেল আজিজ প্রভাব খাটিয়েছেন। এর উত্তরে তিনি দাবি করেন, কেনাকাটা যখন হয় তখন সেনাপ্রধান হিসেবে এর সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। যদিও তিনি দায়িত্ব নেওয়ার এক দিন পর নজরদারি প্রযুক্তি ক্রয়ের স্বাক্ষর হয়; তিনি দাবি করেন, প্রক্রিয়াগুলো আগেই সম্পন্ন হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করছি, কেউ যদি কোনো একটা ‘এভিডেন্স’ দিতে পারে যে আমি বিজিবিতে থাকাকালে, আমি সেনাপ্রধান থাকাকালে আমার কোনো ভাই বা আত্মীয়কে বিজিবি বা সেনাবাহিনীর কোনো ‘আর্মস, ইকুইপমেন্ট, অ্যামুনিশান প্রকিউরমেন্ট, কন্ট্রাক্ট’ দিয়েছি—এটা যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে ‘আই উইল অ্যাকসেপ্ট এনিথিং। আই অ্যাম রেডি। আই অ্যাম গিভিং এ চ্যালেঞ্জ’।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জেনারেল আজিজের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ নতুন নাম আর ভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। এ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ‘কত লাখ লাখ বাংলাদেশি লোকজন বিদেশে আছে, তাদের নিজস্ব নাম, পিতৃপরিচয় বা ঠিকানা কি অ্যাকচুয়েলটা ইউজ করেছে?
নাম-পরিচয় পরিবর্তনে তিনি প্রভাব খাটিয়েছিলেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘একটা উদাহরণ দেন—কোনো জায়গায় আমি কাউকে টেলিফোন করেছি কিনা, যে আপনি একে নির্দেশ দিয়েছেন যে এটা করে দাও। এই রকম কোনো এভিডেন্স কি আপনাদের কাছে আছে? প্রমাণ দেন।’
আলজাজিরার তথ্যচিত্রে জেনারেল আজিজ ও তার একজন কোর্সমেটের কথোপকথন ফাঁস করা হয়। এ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আজিজ আহমেদ দাবি করেন, অডিওটি সঠিক নয়। ‘ইট ওয়াজ এ কাট অ্যান্ড পেস্ট। ইট ওয়াজ টেম্পার্ড।’
এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন, ‘এতদিন আমি ইউনিফর্মে ছিলাম। এটার ব্যাপারে যদি আমি কোনো লিগ্যাল অ্যাকশনের বা ব্যবস্থা নিতাম অনেকে প্রশ্ন করত যে আই অ্যাম এক্সারসাইজিং মাই অথরিটি। আই অ্যাম মিসইউজিং মাই পাওয়ার। আমি কিন্তু এখন ইউনিফর্মের বাইরে আসছি। আগামী জুনের ২৫ তারিখের পর আমার সম্পূর্ণ রিটায়ারমেন্ট শুরু হবে। তখন আমি চিন্তা করব হোয়াট কাইন্ড অব লিগ্যাল অ্যাকশন আই শুড টেক এগেন্স্ট দিস কাইন্ড অব প্রপাগান্ডা অ্যান্ড আদার থিংস।’
বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করা হয় তাকে। জবাবে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী কী দায়িত্ব পালন করবে, তার পরিস্কার নির্দেশনা ছিল। চাইলেই সেনাবাহিনীর যা করার এখতিয়ার নাই। নির্বাচন কেমন হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় ভালো নির্বাচন হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১১২
আপনার মতামত জানানঃ