অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস গুরুত্বপূর্ণ সব মানবাধিকারের গল্প বলার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করা সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সাহস ও সংকল্পের প্রশংসা করার মধ্য দিয়ে মানবাধিকার সাংবাদিকতার শ্রেষ্ঠত্ব উদযাপন করে থাকে।
এবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই ইউনিট) ও আল-জাজিরা ডট কম নিউজ ডেস্ক ৮ম বার্ষিক অ্যামনেস্টি মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডে ‘সেরা মানবাধিকার সাংবাদিকতা’ ক্যাটাগরিতে শীর্ষ পুরস্কার পেয়েছে।
বাংলাদেশের পটভূমিতে নির্মিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ তথ্যচিত্রের জন্য ইনভেস্টিগেশন ক্যাটাগরিতে আই ইউনিট এই পুরস্কার লাভ করে।
গতকাল বৃহস্পতিবার আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
তথ্যচিত্রে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়।
ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গোপনে ইসরায়েলের কাছ থেকে স্পাইওয়্যার কিনেছে।
তবে বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে আড়ি পাততে সক্ষম এই সফটওয়্যার জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছিল।
আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের পরিচালক ফিল রিজ বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সবার সামনে উন্মোচন করা আই ইউনিটের মৌলিক নীতির অংশ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে ইনভেস্টিগেশন অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড পাওয়া বড় সম্মানের।’
এ ছাড়াও, ‘অ্যা তাইগ্রেয়ান উম্ব শুড নেভার গিভ বার্থ: রেপ ইন তাইগ্রে’ প্রতিবেদনের জন্য আল-জাজিরার ডিজিটাল ওয়েবসাইট রিটেন নিউজ ক্যাটাগরিতে শীর্ষ পুরস্কার পেয়েছে।
এই প্রতিবেদনে সাংবাদিক লুসি কাসসা ইথিওপিয়ার পশ্চিমে তাইগ্রে অঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের ওপর নির্যাতন, লুটপাট, ধর্ষণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। সাক্ষাৎকারদাতাদের দাবি, দেশটির আমহারা বাহিনী এসব অপরাধ করেছে।
আল-জাজিরার অনলাইন ইংরেজি সংস্করণের ম্যানেজার সোরাইয়া সালাম বলেন, ‘এটি খুবই ঝামেলাপূর্ণ প্রতিবেদন ছিল এবং এর পেছনে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাদের নিয়ে আমি খুবই গর্বিত।’
গত ৪ মে লন্ডনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই অ্যাওয়ার্ডের ঘোষণা দেয়।
অন্যান্য ক্যাটাগরিতে বিজয়ী ও চূড়ান্ত পর্যায়ে মনোনয়ন পাওয়া গণমাধ্যমের মধ্যে আছে দ্য গার্ডিয়ান, দ্য সানডে টাইমস, অডিবল ইউকে, বিবিসি নিউজ, বিবিসি স্টোরিভিল, বিবিসি অ্যারাবিক, আইটিভি, স্কাই নিউজ, বিবিসি নিউজ রাশিয়া ও বিবিসি ডিজিটাল নিউজ।
‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সবার সামনে উন্মোচন করা আই ইউনিটের মৌলিক নীতির অংশ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে ইনভেস্টিগেশন অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড পাওয়া বড় সম্মানের।’
এর আগে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান এবং তার ভাইদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আল জাজিরার প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ দীর্ঘ অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র বিভাগে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ ডিআইজি পুরস্কার জিতেছে। বিশ্বের নামকরা সব সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা করে এ পুরস্কার জিতেছে আল জাজিরার এই তথ্যচিত্র। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া অন্যান্য তথ্যচিত্রের মধ্যে ছিল বিবিসি নির্মিত ‘দ্য বেইবি স্টিলার’। পুরস্কার দেয়া হয় গত ৩ অক্টোবর।
আল জাজিরার প্রায় এক ঘণ্টার এই প্রতিবেদনে মূলত বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং তার তিন ভাই-এর কার্যক্রম দেখানো হয়েছে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের আপন তিন ভাই ২০০৪ সালে একটি হত্যাকাণ্ডের অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হয়েছিল। এই ভাইদের মধ্যে আনিস আহমেদ এবং হারিস আহমেদ বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
তৃতীয় ভাই, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ, যিনি হত্যার অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন।
যদিও দুই ভাই হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদ পলাতক, কিন্তু আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদকে জেনারেল আজিজ আহমেদের ছেলের বিয়েতে বাংলাদেশে দেখা গেছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয় আনিস আহমেদ থাকেন কুয়ালালামপুরে আর হারিস আহমেদ আছেন হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে।
প্রতিবেদনে গোপন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে বুদাপেস্ট-এ হারিস আহমেদের ব্যবসায়িক কার্যকলাপ নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। তিনি নাম পরিবর্তন করে হাসান মোহাম্মদ নাম নিয়ে বিভিন্ন দেশে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন সেটা দেখানো হয়েছে।
বুদাপেস্টে একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সাথে এক কথোপকথনে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য বুলেট সরবরাহের কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।
আল জাজিরার ঐ প্রতিবেদনে হারিস আহমেদকে বলতে শোনা গেছে পুলিশের চাকরি, যেমন থানার ওসির পদ, পেতে কত টাকা নেয়া হয় । তিনি সেখানে বলছেন, এক্ষেত্রে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। এই কাজে সরকারের শীর্ষ স্থানের লোক জড়িত থাকেন বলে হারিস আহমেদ উল্লেখ করেন।
এছাড়া র্যাবকে ইচ্ছামাফিক নিজের কাজে ব্যবহারের কথাও বলতে শোনা যায় হারিসকে: ‘আমার গুন্ডা অইলো অহন র্যাব। আমার আর গুন্ডা লাগে না, আমার তো এইডিই গুন্ডা। কাউরে উডাই লইয়া আও, কাউরে ধরো…ওরাও খায়, আমিও খাই। ডাইরেক্ট কথা!’ র্যাবকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী সেলিম প্রধানের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করেছেন এবং তাকে গ্রেপ্তার করিয়েছেন, তা নিয়েও হারিসকে দম্ভোক্তি করতে শোনা যায় আল জাজিরার এই তথ্যচিত্রে।
এছাড়া, নিরাপত্তা বাহিনী ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন নজরদারি করার প্রযুক্তি ইসরায়েল থেকে আমদানি করেছে এমন কিছু নথিপত্র দেখানো হয়েছে। তবে এই ক্রয়ের সাথে হারিস আহমেদের কোন যোগাযোগের কথা এই প্রতিবেদনে বলা হয়নি।
তথ্যচিত্রটি প্রচারের পর বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিক্রিয়ায় বলে: ‘এই প্রতিবেদন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ‘কুৎসা রটনার’ একটি প্রচার অভিযান বলেই প্রতীয়মান। এটি তৈরির পেছনে রয়েছে চরমপন্থী গোষ্ঠী, ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জড়িত একদল কুখ্যাত ব্যক্তি এবং এখানে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কিছু পরোক্ষ ইঙ্গিতপূর্ণ কথা ছাড়া আর কিছুই নেই’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আল জাজিরার প্রতিবেদনের পর যাদের তদন্ত করার কথা, তারাও তা না করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ যাদের প্রশ্ন তোলার কথা তারাও প্রতিবাদই করেছেন৷ কেউ কোনো প্রতিবেদন করলেই যদি তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণ শুরু হয়, তাহলে প্রশ্নটা তুলবে কে? দেশের আইনের শাসন ও নৈতিকতার ওপর মনে হয় এত বড় আঘাত এর আগে কখনো আসেনি। একজন সেনাপ্রধান নিয়োগে এতটাই এবং এতটাই বেপরোয়া মনোভাব দেখানোর ভয়ানক পরিণতি! দেশটার ন্যুনতম নৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০২
আপনার মতামত জানানঃ