ট্রাম্প যুগের অবসান ঘটিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হলে গদিতে বেশ নড়েচড়ে বসেছিল বাংলাদেশ সরকার। ক্ষমতাসীন সরকার দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা লুকোতে চীন, ভারত আর আফগানিস্তানের আগুনের তলে বসে নিজের গা গরম করছিল গণমাধ্যমে। পোশাক খাতে আমেরিকার বাজারে শক্ত অবস্থানকে সামনে রেখে দেশটির সাথে সম্পর্কের উন্নয়নের দাবি জানিয়ে আসছিল আওয়ামীলীগ সরকার।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে ডাক না পাওয়ার ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে র্যাবের কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা, এরপর সাবেক সেনাপ্রধানকে দেশটিতে অবাঞ্চিত ঘোষণা বিশ্বে আওয়ামীলীগের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অধঃপতন অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সূত্র মতে, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজকে যুক্তরাষ্ট্রে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই তার মার্কিন ভিসা বাতিল করা হয়েছে। উল্লেখ্য, জেনারেল আজিজ আহমেদ ২০২১ সনের ২৪শে জুন অবসরে যান।
এক পত্র মারফত জেনারেল আজিজকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। কাতারভিত্তিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল জাজিরায় জেনারেল আজিজের দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের খবর প্রচারের পর যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
[zoomsounds_player songname=”তাসনীম খলিল ” type=”detect” dzsap_meta_source_attachment_id=”23492″ source=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/12/Tasneem-Khalil.mp3″ thumb=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/12/তাসনীম-খলিল-1.jpg” config=”default” autoplay=”off” loop=”off” open_in_ultibox=”off” enable_likes=”off” enable_views=”off” enable_rates=”off” play_in_footer_player=”default” enable_download_button=”off” download_custom_link_enable=”off”]
এ প্রসঙ্গে সুইডেন ভিত্তিক অনুসন্ধানী ও জনস্বার্থ বিষয়ক ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল স্টেটওয়াচ-কে বলেন,
“যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসন ক্লিপটোক্রেসি বা চোরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে পলিসি নিয়েছে সেটি অনুযায়ী তারা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জায়গার যারা বড় দুর্নীতিবাজ আছেন, তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা ও তাদের দেশটিতে অর্থ সম্পদ রাখার বিষয়টি বন্ধ করার চেষ্টা করছে। এটা আমরা সম্প্রতি শেষ হলো যে ‘সামিট ফর ডেমোক্রেসি’, সেখানে দেখতে পেয়েছি। আমার মনে হয় যে এরই একটি অংশ হিসেবে এই জেনারেল আজিজের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিল ও তাকে দেশটিতে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছে। এই নিষেধজ্ঞা সম্ভবত তার পরিবারের উপরও বর্তাবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমি মনে করি যে আল-জাজিরার যে ডকুমেন্টারি ছিল “অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন”, সেখানে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দেখানো হয়েছিল যে কীভাবে তিনি বাংলাদেশের প্রথেমে বিজিবি প্রধান ও পরে সেনাপ্রধান হিসেবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ সম্পদ করেছেন, লুটপাট করেছেন। তার ভাইদেরকেও তিনি অর্থসম্পদ লুটপাটে সাহায্য করেছেন। আমার মনে হয় যে এই প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব গুরুত্বের সাথে দেখছেন এবং এরই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।”
এ প্রসঙ্গে আল-জাজিরার সেই তথ্যচিত্র “অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন”র মূল তথ্যদাতা জুলকার নাইন সায়ের (সামি) স্টেটওয়াচ-কে বলেন,
“জেনারেল আজিজের মত দুর্নীতিবাজ একজন ব্যক্তির সামরিক আইন অনুযায়ী যথাযথ শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। ভিসা বাতিল তার শাস্তির দাবী জোরালো করবে। একজন অতি উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হয়ে যেভাবে তিনি নিজের পদবী ও কার্যালয় ব্যবহার করে তার দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী ভাইদের বিভিন্ন রকমের সুযোগ সুবিধা ও নানা রকমের দুর্নীতিতে সহায়তা করেছেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও লজ্জার।”
আল-জাজিরার প্রতিবেদন
সম্প্রতি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ও তার ভাইদের নানা কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কাতার-ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার করা “অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন” নামক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন গোট দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
আল জাজিরার প্রায় এক ঘণ্টার এই প্রতিবেদনে মূলত বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং তার তিন ভাইয়ের কার্যক্রম দেখানো হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের আপন তিন ভাই ২০০৪ সালে একটি হত্যাকাণ্ডের অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হয়েছিল।
এই ভাইদের মধ্যে আনিস আহমেদ এবং হারিস আহমেদ বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। তৃতীয় ভাই, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ, যিনি হত্যার অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন।
যদিও দুই ভাই হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদ পলাতক, কিন্তু আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদকে জেনারেল আজিজ আহমেদের ছেলের বিয়েতে বাংলাদেশে দেখা গেছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয় আনিস আহমেদ থাকেন কুয়ালালামপুরে আর হারিস আহমেদ আছেন হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে।
প্রতিবেদনে গোপন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে বুদাপেস্টে হারিস আহমেদের ব্যবসায়িক কার্যকলাপ নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। তিনি নাম পরিবর্তন করে হাসান মোহাম্মদ নাম নিয়ে বিভিন্ন দেশে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন; সেটা দেখানো হয় ওই প্রতিবেদনে।
বুদাপেস্টে একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সাথে এক কথোপকথনে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য বুলেট সরবরাহের কথা বলতে দেখা যায়। আল জাজিরার ওই প্রতিবেদনে হারিস আহমেদকে বলতে শোনা গেছে পুলিশের চাকরি, যেমন থানার ওসির পদ পেতে কত টাকা নেয়া হয়। এই কাজে সরকারের শীর্ষ স্থানের লোক জড়িত থাকেন বলে হারিস আহমেদ উল্লেখ করেন।
কী ছিল জেনারেল আজিজের বক্তব্য?
আল-জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতির গর্ব, দেশের গর্ব। এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার চলছে। সেনাবাহিনী অত্যন্ত প্রশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল, আগের চেয়ে অনেক বেশি সুসংহত। সেনাবাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ অত্যন্ত কার্যকর এবং সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্য ঘৃণাভরে এ ধরনের অপচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করছেন।
জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের চেইন অব কমান্ডে যারা আছেন, সবাই এ ব্যাপারে সতর্ক আছি। সেনাবাহিনীতে এ ধরনের অপপ্রচার বিন্দুমাত্র আঁচ আনতে পারবে না। সেনাবাহিনী দেশের সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ, বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুগত। বর্তমান সরকারের যে কোনো আদেশ-নির্দেশ পালনে সদা প্রস্তুত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ, বহির্বিশ্বে যে কোনো সমস্যা মোকাবিলার জন্য সাংবিধানিকভাবে আমরা শপথবদ্ধ।’
তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যে কথাটা বলা হয়েছে, আমি আপনাকে প্রশ্ন করি আপনার বিরুদ্ধে মামলা আছে, সাজা আছে; কিন্তু গতকাল যদি আপনার বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা না থাকে, তাহলে আপনাকে কি আজ ফিউজিটিভ (পলাতক) বলা যাবে? আপনাকে কি বলা যাবে আপনি সাজাপ্রাপ্ত? যখনই আপনি অব্যাহতি পেয়ে যান কোনো একটা চার্জ থেকে, তার পরের দিন থেকে আপনি যে কোনো মুক্ত নাগরিকের মতো।’
মালয়েশিয়ায় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করা প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমি মালয়েশিয়ায় যখন দেখা করেছি, তখন তার নামে কোনো মামলা ছিল না। যে একটা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা ছিল, সেটি থেকেও অব্যাহতিপ্রাপ্ত ছিল। সে অব্যাহতি মার্চ মাসে হয়েছিল, এপ্রিলে আমি গিয়েছিলাম। এখানে আল-জাজিরা যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে, সেটি সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে দিয়েছে। কারণ, সেদিন আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে না কোনো সাজা ছিল, না তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল। তার আগেই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১০২৫
আপনার মতামত জানানঃ