বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে এ ব্যবস্থা নিয়েছে ওয়াশিংটন। সোমবার রাতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করে ওয়াশিংটন ফিরে যাওয়ার পরপরই এ ঘোষণা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে বলেছেন, দুর্নীতিতে উল্লেখযোগ্য সম্পৃক্ততার কারণে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নিয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ন করতে ভূমিকা রেখেছে। কূটনৈতিক সূত্রমতে, জেনারেল (অব.) আজিজের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল।
আলজাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান’ নামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তখন যে ধারায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল; ওই ধারায় তা প্রকাশ করা যায় না। এবার ধারার পরিবর্তন করে নতুন যে ধারায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাতে নাম প্রকাশ করা যায়। অনেকে মনে করেন, এবারের
সফরকালে ডোনাল্ড লুর নমনীয় বক্তব্যে সরকারের রাজনৈতিকবিরোধী পক্ষে বেশ খানিকটা হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল।
ওয়াশিংটন সম্ভবত এ ক্ষেত্রে আজিজের নাম প্রকাশ করে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই অ্যাকশনের কড়া কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
আজিজ অবসরে চলে যাওয়ায় তার দায়কে টেনে সরকার নিজের কাঁধে না নেওয়ার কৌশল নিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ সরকারের অফিশিয়াল অবস্থান হলো, ওয়াশিংটন দুর্নীতির কোনো প্রমাণ হাজির করলে সেটা দুর্নীতি দমন কমিশন নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখবে।
ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আজিজ আহমেদ তার ভাইকে বাংলাদেশে অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সাহায্য করেছেন। আর এটা করতে গিয়ে তিনি সরকারি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িত হয়েছেন। এছাড়া অন্যায়ভাবে সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। একই সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুস গ্রহণ করেছিলেন।
ম্যাথিউ মিলার বলেন, এ পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং আইনের শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা আবারও নিশ্চিত করা হলো। সরকারি সেবা আরও স্বচ্ছ ও নাগরিকদের সেবা লাভের সুযোগ তৈরি করার পাশাপাশি ব্যবসা ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উন্নয়ন এবং অর্থ পাচার ও অন্যান্য অর্থনৈতিক অপরাধের অনুসন্ধান ও বিচার নিশ্চিতে সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টায় সহায়তা করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।
উল্লেখ্য, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদকে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১(সি) ধারার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এ পদক্ষেপের ফলে আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যরা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হবেন।
জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে তিনি যে কোনো পরিণতি মেনে নেবেন বলেও মন্তব্য করেন।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আগেই বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, জেনারেল (অব.) আজিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানার প্রতি জোর দেন।
সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে আজিজ আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৮ সালের ২৫ জুন। ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। আজিজ আহমেদের ভাই হারিছ ও জোসেফ অসত্য তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বানিয়েছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। জোসেফের সাজা মওকুফেও সেনাপ্রধানের প্রভাব ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার ফের ক্ষমতায় যাওয়ার পর সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফর করেছেন। সফরকালে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইসহ বিভিন্ন ইস্যুতে একত্রে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে টেনশন ছিল বলে স্বীকার করেছেন।
নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও অহিংস নির্বাচনে বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছিল। বাইডেন প্রশাসনের ওই ভিসানীতির আলোকে জেনারেল (অব.) আজিজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এবারের নিষেধাজ্ঞা অন্য ধারায় দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন।
যদিও ডোনাল্ড লু বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সামনে তাকাতে চায়। তবে তিনি বাংলাদেশ সফর শেষ করার পরপরই জেনারেল (অব.) আজিজ আহমদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা এলো। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব ও তার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। বাংলাদেশের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি।
আপনার মতামত জানানঃ