রোহিঙ্গা সংকটের জরুরি সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘে এক প্রস্তাব পাশের সময় এই ইস্যুতে বাংলাদেশ কতটা বন্ধুহীন, সেটাই বেরিয়ে এসেছে। ওই ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ পাশে পায়নি তার কোনো প্রতিবেশী দেশকে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নজিরবিহীন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে মর্মে দাবি করে আসছে দুই দেশের সরকার। চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক দিন দিন উন্নতির পথে বলা হচ্ছে। অথচ জাতিসংঘে যখন ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক রেজুলেশনের ওপর ভোট হলো, তখন দেখা গেল ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি, আর চীন দাঁড়িয়েছে বিরুদ্ধে।
নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। দক্ষিণ এশিয়ার একই জলবায়ুতে অবস্থান দেশগুলোর। তবু এই আত্মীয়রাও পাশে দাঁড়ায়নি বাংলাদেশের। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ নয়, বরং মিয়ানমারকেই বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কোন তাগিদ অনুভব করেনি। একযোগে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশের বিপক্ষে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ সরকার তার কূটনৈতিক দুর্বলতা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
১৮ নভেম্বর ২০২০ চতুর্থবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে রেজুলেশনটি উত্থাপন করে, যাতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে ১০৪টি দেশ। রেজুলেশনটির পক্ষে ভোট দেয় ১৩২টি দেশ, বিপক্ষে ভোট দেয় ৯টি। আর ভোট দানে বিরত থাকে ৩১টি দেশ। বিপক্ষে ভোট দেয়া দেশগুলো হলো : রাশিয়া, চীন, মিয়ানমার, বেলারুশ, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, জিম্বাবুয়ে ও লাওস। ভোট না দেয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিবেশী ভারত, সার্কভুক্ত নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভেনেজুয়েলা ইত্যাদি।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে সমর্থন জোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। কিন্তু বাংলাদেশের দূতালির কারণে নয়, বরং চীনকে ঠেকাতেই তারা এসব করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগ্রহ ও চেষ্টা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যবস্থা পশ্চিমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এজন্য বাংলাদেশকে চীন ও ভারতের সহযোগিতা পেতে হবে। প্রধানত পুরো বিষয়টি চীনের ওপরই নির্ভরশীল, তবে ভারতেরও চাপ সৃষ্টি করার মতো ক্ষমতা রয়েছে। নেপাল, ভুটান শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়ার মতো দেশ যদি এক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, সেটাও কাজে দেবে। কিন্তু এই দেশগুলো একটিও বাংলাদেশের পক্ষে নেই। এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সরকার কূটনৈতিক স্তরে ব্যর্থতার গণ্ডিতেই এখনো আবদ্ধ।
চীনের বিরোধিতা সত্ত্বেও পশ্চিমাদের প্রচেষ্টায় জাতিসংঘে প্রস্তাবটি পাশ হয়েছে, এটা বাংলাদেশের জন্য সুখবর মনে করা হচ্ছে! প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারকে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যও আহ্বান জানানো হয়েছে। বিষয়গুলো হলো, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানসহ সমস্যাটির মূল কারণ খুঁজে বের করা, প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা, প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পদক্ষেপ হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
এবারের রেজুলেশনটিতে অনেক নতুন বিষয় উঠে এসেছে। যেমন, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের সাময়িক আদেশ, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের তদন্ত শুরুর বিষয় এবং রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘুদের মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে বঞ্চিত করা ইত্যাদি।
তাছাড়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানসহ সমস্যাটির মূল কারণ খুঁজে বের করা, প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত, প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পদক্ষেপ হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মতো সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যও মিয়ানমারকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
মিই/আরা/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ