
মিয়ানমারের মংডুর সুয়েজা গ্রামের বাসিন্দা ইলিয়াছ ও জমিলার উনিশ বছরের একমাত্র মেয়ে আরমিনা। আরাকান আর্মির হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে নানা কৌশলে সীমান্ত দিয়ে পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশে। ৮ দিন আগে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আরমিনার অবস্থান এখন কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তিনি রাখাইনে আরাকান আর্মির হাতে নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
উখিয়ার ১১ নাম্বার ক্যাম্প আশ্রয় নেয়া আরমিনা (১৯) বলেন, ‘আরাকান আর্মি বেশি জুলুম করছে। প্রতিদিনিই এসে রোহিঙ্গা যুবতীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এসব জুলুম সহ্য করতে না পেরে আমার মা-বাবা আমাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। ৮ দিন হলো বাংলাদেশের ক্যাম্পে এসেছি। এর আগে মিয়ানমারের পেরাংপুর থেকে নৌকায় উঠে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফে জাদিমুরা দিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। পরে ক্যাম্পে মামাকে ফোন দিয়েছি, তারপর মামা এসে আমাকে জাদিমুরা থেকে উখিয়ার ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে।’
আরমিনার মতো মিয়ানমারের মংডু কিংবা বুচিদং থেকে অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে। কেউ এসেছেন একমাস আগে আবার কেউ এসেছেন ১ সপ্তাহ কিংবা ১০ দিন আগে। তাদের মধ্যে দুজন শাহদাত উল্লাহ ও জয়নাল। তারা জানান, আরাকান আর্মি দখলে নেয়ার পর রাখাইনের গ্রামগুলোতে আগের চেয়ে বেড়েছে রোহিঙ্গা নিধন।
নতুন আসা শাহদাত উল্লাহ (২৭) বলেন, ‘আরাকান আর্মি বেশি জুলুম করছে, যা সহ্য করতে না পেরে চলে এসেছি। ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে সবকিছু লুটপাট করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানেও মারধর করে বুচিদংয়ের জেলখানায় রেখেছে। জেলখানা থেকে আমাদের ৫ জনকে কাজ করতে নিয়ে যায়, সেখানে সন্ধ্যায় ৭টায় গাড়ি থেকে নামালে পালিয়ে যেতে চাই। যার মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার সময় ৪ জনকে মেরে ফেলেছে আর আমি বেঁচে ছিলাম। আমি কোনোরকম পাহাড়ের পথ দিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি।’
মোহাম্মদ জয়নাল ((২৩) বলেন, ‘চরে নিয়ে গিয়ে মানুষ গুলি করে মেরে ফেলছে, জবাই করে মারছে। কাফনের কাপড় পর্যন্ত পাচ্ছে না। মানুষ যেগুলো চোখে লাগছে সেগুলোকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। যাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাদের কোনো খোঁজ-খবর পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এই জুলুম থেকে বাঁচতে অনেক কষ্ট করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে জাদিমুরা হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি, অনেক টাকা দিতে হয়েছে দালালকে। একজনের জন্য মিয়ানমারের ৭ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।’
অনুপ্রবেশ করা আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা জানালেন, রোহিঙ্গা তরুণ-তরুণীদের জিম্মি করছে আরাকান আর্মি। পুড়িয়ে দিচ্ছে বসতি আর অভিযানের নামে ধরে নিয়ে ব্যবহার করছে তাদের নানা কাজে।
মোহাম্মদ ইলিয়াছ (৪৮) বলেন, ‘জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মি রাজনীতি করছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে পারছে না বলে জান্তা বাহিনী চলে গেছে। তারপর আরাকান আর্মি বলছে, এটা আমরা যুদ্ধ করে পেয়েছি। এটা রোহিঙ্গাদের জায়গা না। আর তোমরা যদি রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে থাকতে চাও তাহলে তোমাদের যুবকদের আরাকান আর্মিতে যোগ দিতে হবে। তারা জোর করে রোহিঙ্গা যুবকদের নিয়ে যাচ্ছে এটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আর কোনো খোঁজ-খবর নেই। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের যুবতিদের কীভাবে নির্যাতন করছে এটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।’
ক্যাম্প ১১-এর সি ব্লকের সাব মাঝি নুর আলম (৫০) বলেন, ‘এ পর্যন্ত নতুন করে ৩০০ থেকে ৪০০ পরিবার এই ক্যাম্পে এসেছে। যার মধ্যে আমার আওতাধীন তালিকায় ছিল ১১৫ পরিবার। আর গত কিছুদিনের মধ্যে জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আরও অনেক রোহিঙ্গা এই ক্যাম্পে চলে আসছে। যেখানে নারী-পুরুষ সবাই রয়েছে।
রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতারা বলছেন, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর পর এবার আরাকান আর্মিও রাখাইনকে রোহিঙ্গাশূন্য করার মিশনে নেমেছে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের (৫৫) বলেন, ‘রাখাইনে ১৭টি শহর রয়েছে। যার মধ্যে ১৪টি এখন আরাকান আর্মির দখলে। তাদের হাতে রয়েছে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আর রাখাইনে বাকি শহরগুলোতে জান্তা বাহিনীর হাতে রয়েছে আরও ২ লাখ রোহিঙ্গা। তবে জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে তাড়িতে দিতে এখন দায়িত্ব দিয়েছে আরাকান আর্মির হাতে। জান্তা বাহিনী যেভাবে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে তাড়িয়ে দিয়েছে সেই একই রকমভাবে নির্যাতন করছে যাতে বাকি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে বা বিদেশে পালিয়ে যায়। তারা মূলত রাখাইনকে রোহিঙ্গাশূন্য ও মুসলিম শূন্য বানাতে চাচ্ছে।’
মোহাম্মদ জোবায়ের আরও বলেন, ‘ঘর থেকে খেত-খামারে যেতে চাইলে ২ হাজার টাকা, বাজারে যেতে চাইলে ৫ হাজার টাকা, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে ১০ হাজার টাকা দিতে হয় আরাকান আর্মিকে। আর সময়ে সময়ে গ্রামের মধ্যে খারাপ লোক ঢুকেছে বলে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে, তারপর ঘর-বাড়ি থেকে মালামাল লুট করে রোহিঙ্গা যুবকদের ধরে ধরে নিয়ে যায় আর রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করছে। রোহিঙ্গাদের যুবকদের অনেককে পিটিয়ে মেরে ফেলছে আবার অনেককে জেলখানায় ঢুকিয়ে রাখছে। এসময় অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের কে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে নিয়ে যায়। আর সেখানে অন্য জাতিগোষ্ঠীদের থাকতে দিচ্ছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের বলে, তোমরা এই নির্যাতন সইতে পারবে না। তোমাদেরকে আরও অনেক জুলুম নির্যাতন করব। তাই তোমরা রাখাইন থেকে চলে যাও বাংলাদেশে। আবার বাংলাদেশে যেতেও ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দিতে হয় আরাকান আর্মিকে, তারপর তারা সীমান্তে যেতে অনুমতি দেয়। এসব নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে আসছে। প্রতিদিনই টাকা বিনিময়ে ৫০ জন কিংবা তার চেয়েও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের থাকতে দিবে না আরাকান আর্মি।’
এদিকে নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে বসবাসের জন্য বসতি বরাদ্দ দিতে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন, এমনটা জানিয়েছেন ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।
কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা ওদেরকে বলেছি এখানে কোনো জায়গা নেই। এই মুহুর্তে কী করণীয়। তখন আপাতত কমিউনাল সেন্টারগুলো সংস্কার করার জন্য বলা হয়েছে। এই সেন্টারগুলো তারা মেরামত করে সেখানে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের রাখার প্রাথমিকভাবে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পহেলা মে পর্যন্ত নতুন আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার। আর গত এক সপ্তাহের মধ্যে আনুমানিক ৩ হাজারের বেশি নতুন রোহিঙ্গা এসেছে, যার তথ্য এখনো হালনাগাদ করা হয়নি।
সরকারের হিসেবে, দেশে ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারে সহিংসতার সময় পালিয়ে আসে। এর মধ্যেই নতুন করে আরও ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ