বাংলাদেশের সব উন্নয়ন কেবল বড় বড় প্রকল্প সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এই প্রকল্পগুলো তৈরীর জন্যেও টাকা আসছে জনগনের পকেট থেকে। দেশের আর্থিক অবস্থা যখন শনির দশায় তখনও লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না উন্নয়নের পেছনে করা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয়ের। লাফিয়ে লাফিয়ে খরচ ও মেয়াদ বাড়ানোই বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্ধারিত মেয়াদ ও ব্যয়ে প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার নজির ভুলে গেছে দেশের মানুষ, বরং না হওয়াটাই এখন উন্নয়নের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খাল খননে ব্যয় এক হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা
চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার খাল খননের খরচ ৩২৬ কোটি টাকা থেকে এখন এক হাজার ৩৭৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। তিন বছরে যেখানে প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল সেটি চলছে সাত বছর ধরে।
এখন নতুন করে বাড়ছে আরো তিন বছর প্রকল্পের মেয়াদ। বলা হয়েছে, মামলাজনিত কারণে খাল খননের জন্য নির্ধারিত মেয়াদে ভূমি অধিগ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা। চার গুণের বেশি খরচ বাড়ানোর জন্য এটিই মূল যুক্তি।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ থেকে এই অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাব পর্যালোচনা করে যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার জন্য বলা হয়েছে।
যে কারণে এই ব্যয় বৃদ্ধি
প্রকল্প প্রস্তাবনা ও ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধানের তথ্য থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২.৯ কিলোমিটার খাল খনন করার জন্য ২০১৪ সালের ২৪ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) ৩২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয়।
২০১৭ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ করার কথা। খালের প্রস্থ হবে ৬৫ ফুট। উদ্দেশ্য ছিল শহরটির জলাবদ্ধতা নিরসন। ১৯৯৫ সালে প্রণীত চট্টগ্রাম ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের সুপারিশক্রমে ড্রেনেজ এরিয়া ৭-এর ২ হাজার ২৬৪ হেক্টর এরিয়ার পানি নিষ্কাশন তথা জলাবদ্ধতা নিরসনের স্বার্থে এই প্রকল্পটি নেয়া হয়।
এর পরে ২০১৮ সালের ১১ জুলাই একনেক থেকে এক লাফে এই প্রকল্পের খরচ ৯৩০ কোটি টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকায় অনুমোদন দেয়া হয়। মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরো এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্প সমাপ্ত না হওয়াতে মেয়াদ ও খরচ আবারো বৃদ্ধির দাবি জানায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ব্যয় বাড়িয়ে এক হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ এক হাজার টাকায় উন্নীত করাসহ মেয়াদ আরো তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে তিন বছরের প্রকল্পটি এখন ১০ বছরে গড়াচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সম্প্রতি পর্যালোচনা সভায় জানান, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম নগরীর জন্য মাস্টারপ্ল্যান করে। ওই মাস্টারপ্ল্যানের প্রধান বিষয় ছিল ড্রেনেজ-ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা। মাস্টারপ্ল্যানে প্রস্তাব ছিল দ্রুত বৃষ্টির পানি অপসারণের জন্য বর্তমানে অবস্থিত খালগুলোর পুনর্বাসন এবং কিছু নতুন খাল খনন করা।
মাস্টারপ্ল্যানের সুপারিশের আলোকে ২.৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৬৫ ফুট প্রস্থ খাল খননের সংস্থান এবং খালের উভয় পাশে ২০ ফুট প্রস্থের রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার বিলম্ব এবং ভূমির মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধিত প্রস্তাব একনেক থেকে ২০১৮ সালের ১১ জুলাই অনুমোদন লাভ করে।
মামলাজনিত জটিলতার কারণে ভূমি অধিগ্রহণ যথাসময়ে সম্পন্ন না হওয়ায় এবং রেট শিডিউল পরিবর্তনসহ ডিজাইন পরিবর্তন ও বিভিন্ন অঙ্গের যোজন-বিয়োজনে মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধিসহ প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাব করা হয়।
সিটি করপোরেশন বলছে, আইনি জটিলতা ও ভূমির বিভিন্ন সার্ভে করার কারণে জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এখন এই খাতে ব্যয় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মামলার কারণে যথাসময়ে জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। যেখানে ৯০ শতাংশ ব্যয় এই খাতে সংস্থান ছিল। প্রথমে প্রকল্পে ছয়টি ব্রিজের সংস্থান ছিল। এখন আরো দু’টি ব্রিজ ও একটি কালভার্ট নতুন করে নির্মাণ করা প্রয়োজন। পরামর্শক সার্ভে থেকে প্রাপ্ত ডিজাইন অনুযায়ী কাজের পরিমাণ ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্যয় বৃদ্ধির বাহার
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫.৮ কিলোমিটার রাস্তার জন্য ব্যয় ছিল আট কোটি ৯৩ লাখ টাকা, সেটি এখন ধরা হয়েছে ২৯ কোটি ৯১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২.৯ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণে ৯ কোটি টাকার ব্যয় এখন সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার ড্রেনে ৩৬ কোটি ৪৬ লাখ ৩০ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়ালে ও সিঁড়িতে খরচ ৩৬ কোটি টাকার স্থলে এখন দাঁড়িয়েছে ৯২ কোটি ৯০ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। ৫.৪ কিলোমিটার ফুটপাথ নির্মাণে পাঁচ কোটি ১৩ লাখ টাকার জায়গায় এখন সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারে আট কোটি ৯৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে।
ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রধান প্রকৌশলী পিইসিকে জানান, প্রথমে ২০১২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। এখন এটা ২০১৯ সালের রেট শিডিউল দ্বারা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, যার কারণে খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি পরামর্শক কর্তৃক সার্ভে করার পর ডিজাইনে পরিবর্তন আসে।
ভৌত অবকাঠামো বিভাগ আটটি ব্রিজ ও একটি কালভার্ট নির্মাণে সাড়ে ৪১ কোটি টাকার প্রস্তাবকে অত্যধিক মনে করছে। প্রকল্পে দুই হাজার ৫১৬.৬২ ডেসিমেল জমি অধিগ্রহণ খরচ এক হাজার ১০৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ছিল।
অর্থ বিভাগের উপসচিব মিজ লিজা খাজা উল্লেখ করেন, প্রকল্পটি সাত বছর ধরে চলছে। বর্তমানে আরো তিন বছর মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ ১০ বছর ধরে একটি প্রকল্প চলমান থাকবে। প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব যথাসম্ভব পরিহার করা উচিত।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য খাল পুনঃখনন প্রকল্পও রয়েছে। তাই দ্বৈততা পরিহার করা উচিত বলে পিইসি মনে করছে। ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের ব্যয় পুনরায় রিভিউ-পূর্বক যৌক্তিকভাবে নির্মাণ করতে হবে। এগুলোর ডিজাইন আরডিপিপিতে যুক্ত করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের এই খনন প্রকল্পের মত প্রায় সব প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয় বাড়ানো নিয়ে চিন্তিত দেশের বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন ব্যয় বাড়ানোর লোক দেখানো যুক্তি দিয়ে জনগনকে বোকা বানিয়ে রাখা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ যেভাবে হয়ে আসছে, এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি আরও বড় রকমের হুমকির মুখে পড়বে বলেও মনে করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ