স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার অভিযোগ অনেক পুরোনো। কিছু দুর্নীতির খবর ছিল রীতিমতো কেলেঙ্কারির। কোভিড-১৯ মহামারি আসার পর তা মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দায়িত্বহীনতার কিছু নমুনা এককথায় বিস্ময়কর। জনসচেতনতা এবং করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে, একপ্রকার ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্যবিভাগ। লকডাউন ছাড়া কার্যত কোন পদক্ষেপই নিতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। আবারও ৭ দিনের জন্য লকডাউন বাড়ানোর সুপারিশ জানানো হয়েছে। এছাড়া ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৮ দিন। এতে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পড়ছে দরিদ্র মানুষেরা। মালিক শ্রেণীকে নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত সরকারও তাদের কথা ভাবার সময় করে উঠতে পারছে না। আর বরাদ্দকৃত অর্থও লুটপাট হয়ে যাচ্ছে।
সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যর্থ স্বাস্থ্য বিভাগ
দেশে বেশ আগে থেকেই ছিল সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ও ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট। এরপর দেশে পাওয়া গেছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট।
গতবছরের শীতের সময় থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণের সংখ্যা কমে এলেও মার্চে শনাক্ত বাড়তে থাকে হু হু করে। সেসময় একদিনে সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এ অবস্থায় সরকার কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া আটকাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সেসবও উপেক্ষা করেছে মানুষ। কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি।
এদিকে, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে গণপরিবহন ও বাজার থেকে মানুষের সংক্রমণ হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
শহরে মাস্ক পরার প্রবণতা কম। গ্রামের মানুষ তো ভাবে গ্রামে করোনাই নেই। দরিদ্রদের ধারণা, এটা ‘বড়লোকের অসুখ’।
করোনার ভয়াবহতা বোঝাতে ব্যর্থ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা নিয়ে মানুষকে সঠিক বার্তা দিতে এবং করোনার ভয়াবহতা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ মানুষকে বোঝানো না গেলে লকডাউনের ফল দীর্ঘস্থায়ী হবে না। যেভাবে মানুষকে মোবিলাইজ করার কথা ছিল, সেটা করতে পারিনি আমরা। মানুষের কাছে সঠিক তথ্য যাচ্ছে না।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ৩৪তম সভায় সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। কমিটি মনে করে, ঈদের আগে যাতায়াত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় যায়নি। ঈদের পরও একইভাবে মানুষ ফিরছে, এতে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়ছে।
কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সহিদুল্লা বলেন, সরকার ঘোষিত বিধি নিষেধের কঠোর বাস্তবায়নের সুপারিশ জানিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চত করা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যসেবা শুরু হয় বাড়ি থেকে। স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, পরিবারকল্যাণ কর্মীরা বাড়িতে প্রতিমাসে গিয়ে মা ও শিশুস্বাস্থ্যের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার যেসব বার্তা রয়েছে সেগুলো দিয়ে থাকেন, উঠান বৈঠকসহ নানা কাজ করেন। যার কারণে এখন বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি এতো সাফল্য পেয়েছে বলে জানান জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস।
কিন্তু করোনার শুরু থেকেই জনগণকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মাঠপর্যায় থেকে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের এখানে কাজে লাগানো হলে রোগী শনাক্ত ও তাদের সংস্পের্শে আসাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যেতো। ভিয়েতনাম, ভুটান এভাবেই করোনা প্রতিরোধ করেছে।
সামগ্রিকভাবে কিছু চিন্তা করেনি স্বাস্থ্য বিভাগ
করোনার প্রায় দেড় বছরে স্বাস্থ্যবিভাগ সামগ্রিকভাবে কিছু চিন্তা করেনি। এমন মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল।
তার মতে, এ নিয়ে কোনও তদারকি হয়নি। কারও কোনও জবাবদিহিতাও ছিল না।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ করোনার সময় নিজেদের দুর্নীতি, দুর্বলতা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। করোনা নিয়ে ভাবার মতো সক্ষমতা তাদের ছিল না।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (২১ মে) রোগী শনাক্তের হার ছিল আট দশমিক ২২ শতাংশ, যা কিনা গত এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। আসলে, ঈদের ছুটির আগ থেকে ঈদের তিনদিন পর পর্যন্ত করোনাতে নতুন শনাক্তের সংখ্যা কমে। সে সময় কমে যায় পরীক্ষার সংখ্যাও। তবে ছুটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরীক্ষা ও শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
দরিদ্র মানুষের দূর্ভোগ সীমাহীন
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশে প্রতি চারজনে একজন এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে। নজিরবিহীন এ জনস্বাস্থ্য সংকটে এ দরিদ্র মানুষগুলোকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ মানুষগুলোর রুটি রুজির ব্যবস্থা করার জন্য কোনও পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। দিনে এনে দিনে খাওয়া এসব মানুষদের তাই কোনো ধরনের বিধিনিষেধের মধ্যেও আনা যাচ্ছে না।
করোনা মহামারিতে সংকটে ধনী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য যে মাত্রায় সহায়তার ব্যবস্থা করতে পারছে, ততটা করার সুযোগ বাংলাদেশের নেই। এছাড়া আমাদের দেশে উভয় পক্ষই চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। এখানে সরকারের দিক থেকে পরিকল্পিত উদ্যোগের যেমন অভাব রয়েছে, আবার সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ম মেনে চলার ইচ্ছারও ভীষণ রকম ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ রোধ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
কঠোর লকডাউন হলে হলে হয়তো জীবন বাঁচে, আবার ঢিলাঢালা লকডাউনে জীবিকা বাঁচে। এখন জীবন না জীবিকা, কোনটা বাঁচানোর চেষ্টা করা হবে? জীবন বাঁচানো এবং জীবিকা বাঁচানো– এ দুইয়ের মধ্যে সতর্ক ভারসাম্য রক্ষা করার বড় চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের সামনে। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে, কিন্তু স্থির কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না।
লকডাউনে এক শ্রেণীর মানুষ যারা দিন আনে দিন খায় যেমন রিকশা চালক, দিন মজুর এবং দিন ঠিকা কাজ করার অন্যান্য পেশার মানুষ রয়েছেন যাদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখ যোগ্য অংশ তাদের আয় রোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা নাজুক অবস্থায় পড়েছেন। সরকার অবশ্য শিল্প শ্রমিক, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করলেও এদের জন্য এখন পর্যন্ত তেমন কোন সাহায্যের বন্দোবস্ত করা হয়নি।
লকডাউন আরও ৭ দিন বাড়ানোর সুপারিশ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান বিধিনিষেধ আরও সাত দিন বাড়িয়ে ৩১ মে পর্যন্ত বহাল রাখার সুপারিশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে ২৩ মে (রবিবার) এ সংক্রান্ত আদেশ সংবলিত প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, টানা এক মাসেরও বেশি সময় বিধিনিষেধ বহাল রাখার পর সরকারও জনগণের জীবন-জীবিকার বিষয়টি বিবেচনা করে আর বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়াতে চায় না।
তবে, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার। ইতোমধ্যে যশোর সাতক্ষীরাসহ সীমান্ত জেলাগুলোয় এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণেই সরকারের নীতিনির্ধারকরা বেশি উদ্বিগ্ন।
এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে বিধিনিষেধের মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর প্রস্তাব রেখে তা অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে।
বাড়লো ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ
ভারতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দেশটির সঙ্গে স্থল সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ আরও ৮ দিন বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। ফলে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত সীমান্ত বন্ধ থাকবে।
উল্লেখ্য, করোনার সংক্রমণ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ গত ২৬ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ রেখেছে।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২১ মে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, ‘ভারতের পরিস্থিতি আমরা পর্যব্ক্ষেণ করছি। সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ ৩১ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এরমধ্যেই আবার পর্যালোচনা বৈঠকে বসবো।’
এখন পর্যন্ত ছয়টি বন্দর দিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশি প্রবেশ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ জনের মতো দেশে ফিরছেন।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮৩৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ