জাতীয় বাজেট, সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য খাতের উপেক্ষিত হবার ঘটনা নতুন নয়। এছাড়া বাজেট স্বল্পতা, অব্যবস্থাপনা, দুর্বল অবকাঠামো, জনবলের ঘাটতি, অদক্ষতা, দুর্নীতির কারণে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা একপ্রকার বিধ্বস্ত। রোগীদের থেকেও জীর্ণ।
করোনা মহামারির শুরুতে জরুরি সুরক্ষাসামগ্রীসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন কেনাকাটায় ১৯৩ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে বলে জানা গেছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়ম উঠে এসেছে।
এ–সংক্রান্ত নিরীক্ষা আপত্তি নিয়ে গতকাল রোববার সরকারি হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়। কমিটি কেএন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্ত এবং অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তি করে সুরক্ষাসামগ্রী কেনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সংসদীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জরুরি ভিত্তিতে ১ হাজার ১১২ কোটি টাকার (কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রজেক্ট) প্রকল্প গ্রহণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের প্রথম অর্থবছরের যেসব নিরীক্ষা আপত্তি এসেছে, তার মধ্যে ১২টি নিষ্পত্তি হয়নি।
নিরীক্ষায় একটি আপত্তিতে বলা হয়, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই), মাস্ক ও হ্যান্ডগ্লাভস সরবরাহের জন্য মেসার্স জাদিদ অটোমোবাইলস জেএআইয়ের সঙ্গে ২০২০ সালের ১৯ মে ৩১ কোটি ৯০ লাখ টাকার চুক্তি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি দেড় লাখ কেএন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করার কথা। এর মধ্যে সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) ২৪ হাজার মাস্ক ভেজা অবস্থায় গ্রহণ করেছে। প্রতিটি মাস্ক ৫২০ টাকা হিসাবে এখানে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এই আপত্তির জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সিএমএসডিতে মাস্কগুলো নেওয়ার সময় কোনো মাস্ক ব্যবহার অযোগ্য হিসেবে দেখানো হয়নি। পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা করে মাস্কের গুণাগুণ সম্পর্কে সন্তোষজনক ফল পাওয়া গেছে।
তবে তাদের এই বক্তব্য গ্রহণ করেনি নিরীক্ষা অধিদপ্তর। প্রতিবেদনে বলা হয়, জবাবের সঙ্গে সংযুক্ত প্রামাণিক চালানের কপিতে ‘সিএমএসডি কর্তৃক রিসিভসংক্রান্ত মন্তব্য অংশ’ ঘষামাজা করে মুছে ফেলা হয়েছে। পরীক্ষা প্রতিবেদনের সংযুক্তিও পাওয়া যায়নি।
আরেকটি আপত্তিতে বলা হয়, চুক্তির চেয়ে দুই হাজার কম মাস্ক সরবরাহ করেছে। প্রতিটি মাস্কের দাম ৫২০ টাকা হিসাবে ক্ষতি হয়েছে ১০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, জাদিদ অটোমোবাইলস চুক্তি অনুযায়ী দেড় লাখ মাস্ক সরবরাহ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, চালানের কপিতে সিএমএসডি কর্তৃক প্রাপ্তিস্বীকারসংক্রান্ত মন্তব্য অংশ ঘষামাজা করে মুছে ফেলা হয়েছে। পুরোনো চালান ঘষামাজা করে মালামাল গ্রহণের প্রমাণক দেওয়া হয়েছে।
করোনাভাইরাসের আলোচনাকে ছাপিয়ে বছরজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে চলে আসে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিষয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও করোনাকালের দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। করোনাকালে বিশ্বে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ২০২১ সালে বাংলাদেশ একধাপ এগিয়ে ১৩তম অবস্থানে উঠে আসে।
এই প্রকল্পের তিনটি প্যাকেজে দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২ লাখ পিপিই ও ৩ লাখ ১০ হাজার মাস্ক এবং ১ হাজার ৫৫০ থার্মোমিটার কেনা হয়। কিন্তু বিতরণের নথিতে দেখা যায়, ১ লাখ ৮৪ হাজার পিপিই, প্রায় ৩ লাখ মাস্ক এবং ৬৫০টি থার্মোমিটার বিতরণের কোনো প্রাপ্তিস্বীকারপত্র নেই। এতে মোট ৩২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার গরমিল রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দাবি, দেশব্যাপী কুরিয়ারের মাধ্যমে এসব পাঠানো হয়। তবে নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, প্রমাণ হিসেবে কুরিয়ার সার্ভিসের যে চালান দেওয়া হয়েছে, তাতে মালামাল গ্রহণ ও বিতরণের বিষয় যথাযথভাবে সন্নিবেশিত ও কর্তৃপক্ষের সই নেই।
পৃথক আপত্তিতে বলা হয়, অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ সরবরাহকারীর কাছ থেকে ৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকার সুরক্ষাসামগ্রী কেনা হয়েছে। যারা গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ এবং কম্বল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ৪৭ কোটি টাকার সামগ্রী অব্যবহৃত ফেলে রাখা হয়। একই প্রকৃতির চিকিৎসাসামগ্রী একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দরে কেনায় ক্ষতি হয় ১৭ কোটি টাকা। সরকারি ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে প্রায় ১১ কোটি টাকার কাজ জামানত ছাড়াই চুক্তি করা হয়। ৬ কোটি টাকার বেশি অনিয়মিত ব্যয় হয় মোবাইল অ্যাপ, টিভিক্লিফ, সফটওয়্যার তৈরির কাজে।
সরবরাহকারী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মালামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় চুক্তি মোতাবেক বিলম্ব জরিমানা ছাড়াই বিল পরিশোধ করায় ৪ কোটি টাকার বেশি সরকারের ক্ষতি হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা দরের চেয়ে বেশি দামে চিকিৎসাসামগ্রী কেনায় সরকারের পৌনে ৮ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় থমকে যায় বাংলাদেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তবে এই মহামারিকালে ভয়াবহভাবে বেড়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। অন্যান্য খাতের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) কেনাকাটা থেকে শুরু করে কোভিড-১৯ পরীক্ষায় জালিয়াতি, নামসর্বস্ব অটোমোবাইল কোম্পানিকে সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের কাজ দেওয়া, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মচারী ও গাড়িচালকের অঢেল সম্পদসহ আরও বেশ কিছু ঘটনা ছিল আলোচনার তুঙ্গে। এর বাইরে সাহেদ-সাবরিনাদের মতো নতুন নতুন নামও উঠে আসে দুর্নীতিবাজদের তালিকায়।
অবস্থা এমন হয়েছে, করোনাভাইরাসের আলোচনাকে ছাপিয়ে বছরজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে চলে আসে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিষয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও করোনাকালের দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। করোনাকালে বিশ্বে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ২০২১ সালে বাংলাদেশ একধাপ এগিয়ে ১৩তম অবস্থানে উঠে আসে।
স্বাস্থ্য খাতের এসব দুর্নীতির ঘটনায় দেখা যায়, দুর্নীতির বিষয় ধরা পড়লে জড়িতদের একপক্ষকে আইনের মুখোমুখি করা হলেও টেবিলের ওপারের কর্তারা আড়ালে থেকে গেছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন ডিজি আবুল কালাম পদত্যাগ করলেও তিনি কেন পদত্যাগ করেছেন এবং কেনইবা তাকে বড় ধরনের শাস্তির মুখোমুখি করা হয়নি, সেসব প্রশ্ন থেকে গেছে। এ ছাড়া কর্মচারী মালেক ও অন্যদের পেছনে যারা চালিকাশক্তি ছিলেন তারাও থেকে গেছেন আড়ালে। আবার কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে গেলে প্রভাবশালীদের চাপে তাদেরও পড়তে হয়েছে নানা ঝামেলায়। কাউকে ওএসডি আবার কাউকে নিজ দফতর থেকে বদলির ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিক রোজিনা স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির একাধিক প্রতিবেদন করায় তাকেও কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করতে হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতের এসব দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে সে সময়ে দুদকের এক প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পে কেনাকাটার ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮’ অনুসরণ করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে মৌখিক আদেশে যন্ত্রপাতি কেনাকাটাসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি এবং বিভিন্ন হাসপাতালের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কয়েকটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। যদিও এতদিনেও সেসব রহস্যের কোনো সুরাহা হয়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৪
আপনার মতামত জানানঃ