সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্যাতন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার কক্ষ থেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি সরানো ও মোবাইলে নথির ছবি তোলার’ অভিযোগে রোজিনা ইসলামকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। আজ সোমবার (১৭ মে) রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষ থেকে নিয়ে যায় শাহবাগ থানা পুলিশ।
রোজিনা ইসলাম পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সোমবার (১৭ মে) বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। পরে খবর পাওয়া যায় তাকে সেখানে কর্মকর্তারা একটি কক্ষে আটকে রেখেছেন।
রোজিনা ইসলামকে আটকে রাখার খবর পেয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই ভবনে যান। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে রোজিনাকে আটকে রাখার কারণ সম্পর্কে গণমাধ্যমকর্মীরা জানতে চাইলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কিছুই জানাননি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার একান্ত সচিব (পিএস) মো. সাইফুল ইসলাম ভূঞার (সিনিয়র সহকারী সচিব) কক্ষে থাকা ‘রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি থেকে কাগজ সরিয়েছেন’—এমন অভিযোগ তুলে বিকেল ৩টা থেকে আটকে রাখা হয় রোজিনাকে। কেড়ে নেয়া হয় তার মোবাইল ফোনও। সচিবালয়ের ৩ নম্বর ভবনের চতুর্থ তলার ৩৩৯ নম্বর কক্ষে সচিবের দফতরের কর্মকর্তারা প্রথমে আটকে রাখেন। পরে সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা সেখানে আসেন।
সেসময় রোজিনা ইসলাম দাবি করেন, সচিবের সঙ্গে দেখা করতে পিএসের রুমে গিয়েছিলেন তিনি, ফাইল থেকে কোনো কাগজ সরাননি।
সচিবের দফতরের মিজান নামের এক কনস্টেবল তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন বলেও কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন রোজিনা।
রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তাকে পুলিশ প্রহরায় বসিয়ে রাখা হয়। এর মধ্যে দু-দফায় অসুস্থ হয়ে পড়েন রোজিনা।
খবর পেয়ে সহকর্মীসহ সাংবাদিক নেতারা ছুটে যান সচিবালয়ে। তারা দফায় দফায় স্বাস্থ্য সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সচিব কোনো কথা বলেননি।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়লে শাহবাগ থানার পুলিশ রোজিনা ইসলামকে ৩৩৯ নম্বর কক্ষ থেকে বের করে আনে। এসময় সেখানে হট্টগোল শুরু হয়। তাকে কোথায় নেয়া হচ্ছে জানতে চান সাংবাদিকরা। এরপর সাংবাদিকদের বাধার মধ্যে তাকে ৩ নম্বর ভবনের নিচে রাখা পুলিশের একটি মাইক্রোবাসে করে শাহবাগ থানার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া যায়।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ বাদী হয়ে এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করবেন বলে জানান জনসংযোগ কর্মকর্তা মাইদুল ইসলাম প্রধান।
মাইদুল ইসলাম প্রধান সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বাস্থ্য সচিব স্যারের পিএসের রুমে কেউ ছিল না—এমন সময় সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম আসেন। এসে তিনি গুরুত্বপূ্র্ণ কিছু ফাইলের ছবি তোলেন, সেই ছবিগুলো এখনো মোবাইলে আছে। কিছু কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এটা একজন অতিরিক্ত সচিব এবং একজন পুলিশ সদস্য দেখে ফেলেন। তারা তাকে চ্যালেঞ্জ করেন যে, এটা আপনি নিয়ে যেতে পারেন না। পরে নারী পুলিশ এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন অভিযোগ দায়ের করা হলো, অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অভিযোগ দায়ের করেছেন উপ-সচিব মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী।’
উপ কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান রাত পৌনে ১০টার দিকে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সাংবাদিক রোজিনাকে আমাদের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, তারা অভিযোগ দিচ্ছে। মামলা হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এর আগে তাকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার বলছি না।
এদিকে রোজিনাকে শাহবাগ থানায় নেওয়ার কিছুক্ষণ পর উপস্থিত সাংবাদিকরা বাইরে বসে বিক্ষোভ শুরু করেন।
রোজিনাকে শাহবাগ থানায় নেওয়ার পর তাকে ওসির কক্ষে রাখা হয়। অন্য সাংবাদিকদের সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
রাত ১০টার দিকে শাহবাগ থানার ওসির কক্ষ থেকে বেরিয়ে রোজিনার ছোট বোন সাবিনা পারভীন সুমী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ও অসুস্থ। ওর শরীর ভালো না। গায়ে জ্বর। সকালে টিকা নিয়েছে। ওর শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।
সচিবালয়ে কী ঘটেছে জানতে চাইলে সাবিনা বলেন, সোর্সের কাছ থেকে ও কিছু ডকুমেন্ট পায়। এরপর স্বাস্থ্য সচিবের রুমে যাবে, সেজন্য কনস্টেবল মিজানকে বলে। উনি বলতেছে যে, কেউ নাই, আপনি ভেতরে বসেন। তখন আপু বলে যে, না আমি বসব না। আমি কিছু তথ্য নিতে আসছি। এরপর মিজান বলে, আপনি ভেতরে বসেন অসুবিধা নাই।
“এর কিছুক্ষণ পর কনস্টেবল মিজানসহ দুই তিনজন এসে ওর ব্যাগ কেড়ে নেয়। বলে যে, ‘আপনি এতদিন অনেক রিপোর্ট করেছেন, স্বাস্থ্যখাত নিয়ে অনেক নেতিবাচক রিপোর্ট করছেন। আপনাকে মাটিতে পুঁতে ফেলব’।”
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রোজিনা ‘হয়রানির শিকার হচ্ছেন’ বলে অভিযোগ করেন তার ছোট বোন।
মিজানসহ অন্যরা রোজিনার ব্যাগ কেড়ে নিয়েছিল অভিযোগ করে তিনি বলেন, তখন তার ব্যাগে কিছু ডকুমেন্ট ঢুকিয়ে দিয়ে থাকতে পারে।
প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে রোজিনা ইসলাম এই মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ কিছু রিপোর্ট করছিলেন। যার মধ্যে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির রিপোর্ট ছিল। আমরা মনে করছি, এতে তিনি মন্ত্রণালয়ের আক্রোশের শিকার হয়ে থাকতে পারেন।’
প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়ে লেখেন, ‘প্রথম আলোর রিপোর্টার রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। যতটুকু জেনেছি, রোজিনা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কিন্তু এখনও তাকে আটকে রাখা হয়েছে, হাসপাতালে নিতে দিচ্ছে না। আমি তাকে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি। নতুবা উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে।’
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মশিউর খান ফেসবুকে লেখেন, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে প্রথম আলোর রিপোর্টার রোজিনা ইসলামের সঙ্গে স্বাস্থ্য সচিবের অফিস স্টাফদের অসদাচরণের তীব্র নিন্দা জানাই।’
এদিকে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবি করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। আজ এক বিবৃতিতে রোজিনা ইসলামকে আটকের ঘটনায় নিন্দা জানান তিনি।
বিবৃতিতে জিএম কাদের বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা করার ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন। রোজিনা ইসলামের সঙ্গেযে আচরণ করা হয়েছে তা লজ্জাজনক।’
এছাড়া অসুস্থ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩৪৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ