পুলিশের ভুলে চট্টগ্রাম কারাগারে হাসিনা আক্তার নামে এক সাজাপ্রাপ্ত আসামির সাজা ভোগ করে আসছিলেন হাসিনা বেগম নামে আরেক নারী। নিজের নামের একাংশ এবং স্বামীর নামের মিলের কারণে প্রায় সাড়ে ১৬ মাস জেল খাটা এই নির্দোষ নারীর মুক্তির আদেশ দিয়েছে চট্টগ্রামের একটি আদালত।
আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ (চতুর্থ) আদালতের বিচারক শরীফুল আলম ভূঁঞার ভার্চুয়াল আদালত এ আদেশ দেন।
হাসিনা বেগমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এই মামলার প্রকৃত আসামির নাম হাসিনা আক্তার (৩০)। তিনি পলাতক রয়েছেন।
আইনজীবী বলেন, নামের আংশিক মিলে দীর্ঘ প্রায় এক বছর পাঁচ মাস হাসিনা আক্তারের সাজা ভোগ করেছেন হাসিনা বেগম। হাসিনা বেগম বর্তমানে কারাগারে বেশ অসুস্থ। তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। বিষয়টি আমি নজরে আনার পর আদালত টেকনাফ থানা ও কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তাকে মুক্তির আদেশ দিয়েছেন। যাদের ভুলে তিনি এই অন্যায় সাজা ভোগ করেছেন আমি তাদের শাস্তির জন্যও আদালতে আবেদন করবো।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নগরের কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক এলাকায় ২ হাজার ইয়াবা বড়ি নিয়ে স্বামী ও দুই সন্তান মো. আনিস, নুর ফাতেমাসহ গ্রেপ্তার হন ২৭ বছরের হাসিনা আক্তার। এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে। তদন্ত শেষে হাসিনা ও তার স্বামী হামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
ওই বছরের ২৭ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান তারা স্বামী-স্ত্রী। পরে পলাতক হয়ে যান। আসামিরা পলাতক থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ১ জুলাই পঞ্চম অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ হাসিনা ও তার স্বামী হামিদকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। পরে তাদের সাজা পরোয়ানাগুলো আদালত থেকে টেকনাফ থানায় যায়।
থানা-পুলিশ সাজা পরোয়ানায় ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইসমাঈল হাজিবাড়ির হাসিনা বেগমকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। কিন্তু প্রকৃত আসামি একই এলাকার চৌধুরীপাড়ার হাসিনা আক্তার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
এদিকে কারাগারে থাকা হাসিনা বেগম গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার স্বামী হামিদ পরিবার ছেড়ে চলে যান। তার দুই মেয়েকে দেখাশোনা করছেন শাশুড়ি হাজরা খাতুন। বড় ছেলে শামীম নেওয়াজ চট্টগ্রাম শহরে এক ব্যক্তির বাসায় কাজ নেন। ওই বাসার গৃহকর্তার মাধ্যমে একজনের সাজা আরেকজন খাটার বিষয়টি জানতে পারেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী গোলাম মুরাদ। এরপর তিনি সবকিছু যাচাইবাছাই করে নিশ্চিত হওয়ার পর গত ২২ মার্চ আদালতে হাসিনা বেগমের মুক্তির জন্য আবেদন করেন। আদালত টেকনাফ থানা-পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
তদন্ত শেষে টেকনাফ থানার পরিদর্শক (অভিযান) খোরশেদ আলম আদালতে প্রতিবেদন দেন গত বৃহস্পতিবার। সেখানে বলা হয়, প্রকৃত আসামি হাসিনা আক্তার। তার পরিবর্তে জেলে আছেন হাসিনা আক্তার। দুজনের স্বামীর নাম মিল থাকলেও শ্বশুরের নামের পার্থক্য রয়েছে। ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।
অনুসন্ধান শেষে তদন্ত প্রতিবেদনে টেকনাফ মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) মো. খোরশেদ আলম দাবি করেন, বর্তমানে সাজা পরোয়ানা মূলে কারাগারে থাকা হাসিনা বেগম ও আগে গ্রেফতার হওয়া হাসিনা আক্তার এক নয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান কারাগারে থাকা হাসিনা বেগমের স্বামী পালাতক থাকায় পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত করা যায়নি। ওই এলাকায় হাসিনা আক্তার নামে কারও অস্তিত্ব নেই। এরপর মঙ্গলবার (৪ মে) সকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ছবিযুক্ত বালামে প্রকৃত হাসিনা আক্তার ও হাসিনা বেগম একই আসামি নন বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। এরপর আদালত আজ তাকে মুক্তির আদেশ দেন।
পুলিশের ভুলে হাসিনা বেগম সাজা ভোগ করায় এ বিষয়ে আদালতের লিখিত আদেশ পাওয়ার পর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ।
তিনি বলেন, “আদেশে কি আছে তা দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনে আবার আবেদন করব। পাশাপাশি হাসিনা বেগমের ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েও আবেদন করা হবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের ভাষায় একটা কথা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত আছে, প্রয়োজনে দশজন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক তবুও যেন একজন নিরপরাধীর সাজা না হয়। বিশ্বের সমস্ত বিচার ব্যবস্থায় এই কথাটি মোটা অক্ষরে স্মরণে রাখা হয়। নিরপরাধীর সাজা যেন না হয় সেজন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। তারিখের পর তারিখ, বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই শেষে আদালত এইজন্যই বিচারের রায় প্রদান করে থাকেন যাতে ফাঁক-ফোঁকরে কোনো নিরপরাধীর সাজা না হয়ে যায়। বাংলাদেশেও এই রীতি রয়েছে। তবুও কোথায় কার যেন ভুলে কীভাবে যেন নিরপরাধীর সাজা হয়ে যায়। এদেশে এই সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে নিরপরাধীর সাজাভোগের উদাহরণ খুঁজে দেখলে দেখা যাবে প্রকৃত আসামির সংখ্যার চেয়ে অতো একটা কম নয়।
তারা জানান, একটা মানুষের খুন হওয়ার ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, দ্রুততম সময়ে আসামির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পর বছর কারাভোগের পর কেউ খালাস পেলেও তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এবিষয়ে উচ্চ মহলের কড়া নজরদারির আহ্বান জানান তারা।
তারা বলেন, স্পষ্টত হয়রানির উদ্দেশ্যে বিচারব্যবস্থার নামে এমন অপব্যবহার আশঙ্কাজনক। এই অপব্যবহার রোধে আদালতের নির্দেশ অনুসারে ওই ঘটনার দ্রুত ও সুচারু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যাতে এর সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত হয়। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীকে কয়েক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ