কবির হোসেন : বিজেপির সাবেক সভাপতি ও ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, বাংলাদেশের গরিবরা খেতে পায় না তাই ভারতে চলে আসে। অথচ বিগত কয়েক বছরের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক আমাদের ভিন্ন অর্থই প্রকাশ করে। বিগত কয়েক বছরের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দেখা গেছে যে, কেবল ভারত নয়, পাকিস্তানেরও চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের মাধ্যমে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অপুষ্টির পরিমাণ, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশু মৃত্যুর হার হিসাব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক বা জাতীয়-যে কোনো পর্যায়ে ক্ষুধার মাত্রা নির্ণয় করতে এই সূচকগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে শূন্য পেলে বুঝতে হবে, ওই অঞ্চলে ক্ষুধা নেই। আর এই সূচকে ১০০ হলো সর্বনিম্ন মাত্রা, অর্থাৎ এটি ক্ষুধার সর্বোচ্চ মাত্রা বোঝাবে।
২০২০ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে দেখা গেছে যে, ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম। অন্যদিকে এই সূচকে ভারতের অবস্থান ৯৪ তম ও পাকিস্তানের ৮৮ তম।
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের (জিএইচআই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০২০ এ বাংলাদেশের স্কোর ২০ দশমিক ৪। সেই হিসেবে বাংলাদেশে ক্ষুধার মাত্রা গুরুতর পর্যায়ে আছে।
তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের সূচকে ১১৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮ তম। আর ভারত ছিল ১০২ তম ও পাকিস্তান ৯৪ তম অবস্থানে। ২০১৮, ২০১৭ সালেও ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই অনেক ওপরে বাংলাদেশের অবস্থান। অর্থাৎ, টানা কয়েক বছর ধরেই বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ভারতের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ।
ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৩ শতাংশ জনগোষ্ঠী অপুষ্টির শিকার। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৯.৮ শতাংশের উচ্চতার তুলনায় ওজন কম; এই শিশুদের ২৮ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের অনুপাতে কম এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে ভারতের ১৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী অপুষ্টিতে ভুগছে। এতে দেখা গেছে, দেশটির পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে যথাযথভাবে বেড়ে না ওঠার হার ৩৭.৪ শতাংশ। এই বয়সের শিশুদের মৃত্যু হার ৩.৭ শতাংশ।
২০১৯ এর ক্ষুধা সূচক বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ অপুষ্টির শিকার; পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশের উচ্চতার তুলনায় ওজন কম; ওই বয়সী শিশুদের ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ শিশুর ওজন বয়সের অনুপাতে কম এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ২০ দশমিক ৮ শতাংশের উচ্চতার তুলনায় ওজন কম, যা প্রতিবেদনের ১১৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে এগিয়ে থাকা অর্থনীতি ভারতের এই সূচকে পিছিয়ে থাকার মূল কারণ বিপুল জনসংখ্যা। খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতিতে ধারাবাহিক উন্নতি অব্যাহত রাখলেও জনসংখ্যার বিপুল বিস্তারের তুলনায় তার গতি ধীর। ভারতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ২০ দশমিক ৮ শতাংশের উচ্চতার তুলনায় ওজন কম, যা প্রতিবেদনের ১১৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অথচ ২০১৪ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ৫৫ নম্বরে। ভারতের এ অবনতির জন্য বিরোধীদলীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেছেন।
কেবল বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকই নয়, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গসহ নিকটবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলো। ক্ষুদ্রতর ভূখণ্ড ও জনসংখ্যা নিয়েও বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বর্তমানে এমন কয়েকটি রাজ্যের সম্মিলিত জিডিপির চেয়েও বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯০৫ ডলার। এর বিপরীতে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ৫৬৬ ডলার। আসামের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ১ হাজার ১৮৬। এছাড়া ঝাড়খণ্ডের মাথাপিছু জিডিপির আকার ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৭ ডলার, বিহারের ৬২৭, মেঘালয়ের ১ হাজার ২৭৬ ও ত্রিপুরার ১ হাজার ৭৩০ ডলার।
আইএমএফের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ১০টি রাজ্যের সম্মিলিত জিডিপির প্রায় সমান ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। ওই সময় পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও আসামসহ ১০ রাজ্যের জিডিপির পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার কোটি ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ২৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।
এর বিপরীতে ভারতের সাম্প্রতিক বছরগুলো কেটেছে অর্থনৈতিক শ্লথতার মধ্য দিয়ে। আইএমএফের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরের সময়টিতেও দুই দেশের অর্থনীতির এ বিপরীতমুখী গতি আরো দৃশ্যমান হয়েছে। সর্বশেষ কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব অর্থনীতিতে চাপ ফেললেও সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতীয় অর্থনীতির শ্লথতা রূপ নিয়েছে সংকোচনে।
সর্বশেষ অক্টোবরে প্রকাশিত আইএমএফের আরেক প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। এ সময় বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপির দিক থেকে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর দুই দেশের সংবাদমাধ্যমেই এ নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়। ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও এ নিয়ে কথা হয়েছে অনেক।
এর পরও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি বাংলাদেশীদের নিয়ে কটাক্ষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। কলকাতাভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাত্কারে তিনি মন্তব্য করেছেন ‘বাংলাদেশীরা খেতে পায় না’ বলে। তার ভাষ্যমতে, এ কারণে বাংলাদেশ থেকে লোকজন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনুপ্রবেশ করছে।
অমিত শাহের এ বক্তব্যে কোনো সত্যতা দেখতে পাচ্ছেন না সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকে তারা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান যে প্রবণতা, সেটিও এ বক্তব্যকে সমর্থন করে না। এ কারণে এ বক্তব্য মোটেও যথাযথ, যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এ বক্তব্য পুরোপুরি রাজনৈতিক। গত কয়েক বছরে বিজেপি এক ধরনের কমিউনাল রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এটি তারই প্রতিফলন। হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগাতে এ ধরনের বক্তব্য রেখেছেন তিনি। তবে আমি মনে করি. এটা অমিত শাহর ব্যক্তিগত মন্তব্য ও বিজেপির রাজনীতিপ্রসূত। আমি মনে করি না এটি ভারতের রাষ্ট্রীয় বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি। হলে তারা আমাদের সঙ্গে বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এভাবে চুক্তি করত না।
এসডব্লিউ/১৩২৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ