করোনাকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণার পরপর ভ্যাকসিন পেতে উঠেপড়ে লাগে কয়েকটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই অধিকাংশ ভ্যাকসিন নিজের দেশের জন্য অগ্রিম কিনে নেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন, ব্রাজিলও একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়। ধনী কতগুলো দেশ নিজেদের লোকজনের কথা ভেবে টিকা সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় উন্নীত হতে চায়, অন্যদিকে স্বাভাবিক টিকাদান থেকেও পিছিয়ে যায় স্বল্পোন্নত দেশগুলো। ধনী দেশগুলো দ্রুত টিকাদান কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারলেও পিছিয়ে আছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো। ব্লুমবার্গে ভ্যাকসিন ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী, ধনী দেশগুলোয় টিকাদান কার্যক্রম চলছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় ২৫ গুণ দ্রুত।
এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশের জন্য পর্যাপ্ত টিকা সরবরাহ হয়েছে। যদিও এ টিকার বেশির ভাগই গেছে ধনী দেশগুলোয়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ টিকা সরবরাহের মধ্যে ৪০ শতাংশই গেছে ধনী দেশগুলোয়। যদিও এ দেশগুলো বৈশ্বিক জনসংখ্যার মাত্র ১১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যদিকে স্বল্পোন্নত ১১ শতাংশ দেশ মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ টিকা পেয়েছে। এ হিসাবে সর্বাধিক আয়ের দেশগুলোর তুলনায় স্বল্পোনত দেশগুলো ২৫ গুণ পিছিয়ে আছে।
ব্লুমবার্গের টিকাবিষয়ক তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৫৪টি দেশে ৭২ কোটি ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমটি টিকাপ্রাপ্তির সঠিক অবস্থা জানাতে এসব দেশের সম্পদের হিসাবের পাশাপাশি নাগরিকদের টিকা পাওয়ার সুবিধার রেকর্ড তুলে ধরেন।
ট্র্যাকার অনুসারে দেখা যায়, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েও এখন পর্যন্ত মোট টিকার ২৪ শতাংশ প্রয়োগ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর। আর পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে দেশটির ৭৫ শতাংশ নাগরিককে টিকা দেয়া হবে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক জনসংখ্যার ২.৭ শতাংশ হয়েও মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ডোজ পেয়েছে পাকিস্তানের নাগরিকরা।
ধনী দেশের সরকারগুলো টিকা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থেকে শত শত কোটি ডোজ আগাম চুক্তির ভিত্তিতে কিনে রেখেছে। ফলে এমন বৈষ্যমের চিত্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যাচ্ছে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে টিকার সুষম বণ্টন নিশ্চিতে এখনও কোনো উপায় বা পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র যে গতিতে টিকাদান চালাচ্ছে তাতে আগামী তিন মাসের মধ্যেই ৭৫ শতাংশ জনগণকে টিকার আওতায় আনার পথে রয়েছে দেশটি। সেই তুলনায় বিশ্বের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক দেশে এক ডোজ টিকাও পাননি তাদের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ নাগরিক। এছাড়া, ব্লুমবার্গের ভ্যাকসিন বৈষম্য নিয়ে করা হিসাবের বাইরে আছে ৪০টির বেশি অতি-দরিদ্র দেশ। এসব স্থানে টিকাদান এত সীমিত যে টিকাদানের সরকারি তথ্যসারণীও প্রস্তুত করা হয়নি। যদিও, হিসাবের বাইরে থাকা এই দেশগুলো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।
বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যা অনুসারে কি পরিমাণ ভ্যাকসিনের ডোজ পাঠানো হবে তা নির্ধারণ করে। একারণে, বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে পার্শ্ববর্তী এলাকার তুলনায় কম বরাদ্দ পাওয়ার মতো বিভেদ। অবশ্য, জনসংখ্যা অনুসারে মাথাপিছু ডোজ সরবরাহে কোনো অঙ্গরাজ্যকেই বঞ্চিত করা হয়নি।
বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ টিকা সমানভাবে বিতরণ নিশ্চিত করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি সব টিকা জনসংখ্যার ভিত্তিতে সমানভাবে বিতরণ করা হতো, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ন্যায্য অংশের চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি টিকা পেয়েছে। পাশাপাশি ন্যায্য অংশের চেয়ে যুক্তরাজ্য প্রায় সাত গুণ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো প্রায় দ্বিগুণ টিকা পেয়েছে। এক্ষেত্রে তালিকায় সবচেয়ে ওপরে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরায়েল। ন্যায্য অংশের চেয়ে দেশ দুটি যথাক্রমে ৯ ও ১২ গুণ টিকা পেয়েছে।
এদিক থেকে বৈশ্বিক গড়ের কাছাকাছি টিকা সরবরাহ পেয়েছে চীন। বৈশ্বিক জনসংখ্যার ১৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করা দেশটি বিশ্বের ২০ শতাংশ টিকার সরবরাহ পেয়েছে। পাশাপাশি চীন স্বল্পোন্নত দেশগুলোয়ও কভিড-১৯ টিকা রফতানি করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ পাঠিয়েছে উপহার হিসেবে বিনা মূল্যে।
এমন বাস্তবতায় বিশ্বের সবচেয়ে কম সম্পদশালী মহাদেশ আফ্রিকার মানুষ সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে।মহাদেশটির ৫৪টি দেশের মধ্যে কেবল তিনটি দেশে এখন পর্যন্ত টিকার আওতায় এসেছে মাত্র এক শতাংশ মানুষ। এখনও ২০টি দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়নি।
ভ্যাকসিন বৈষম্যে হতবাক ডব্লিউএইচও প্রধান
এদিকে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বিতরণে হতবাক করা বৈষম্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান ড. টেড্রোস আডানম গেব্রিয়াসিস। প্রতিটি দেশে শনিবার নাগাদ যে পরিমাণ টিকা প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিলো তা অর্জিত হবে না বলেও সতর্ক করেছেন তিনি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বিতরণে সমতা আনার জন্য দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছে ডব্লিউএইচও। দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা করা কোভ্যাক্স কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছে ডব্লিউএইচও। এই কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় একশ’টি দেশে তিন কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করা হয়েছে।
এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯০টি দেশে দুইশ’ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের আশা করছে কোভ্যাক্স। বিশেষ করে ৯২টি দরিদ্র দেশে ধনী দেশগুলোর মতো একই সময়ে একই পরিমাণ টিকা নিশ্চিত করতে চায় কর্মসূচিটি।
শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউএইচও প্রধান টেড্রোস আডানোম গেব্রিয়াসিস বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে টিকা সরবরাহে হতবাক করার মতো বৈষম্য রয়েছে। উচ্চ-আয়ের দেশগুলোতে প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন করোনাভাইরাসের টিকা পেয়েছেন। নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে এর পরিমাণ প্রতি পাঁচশ’ জনে এক জন।’
কোভ্যাক্স কর্মসূচির বাইরে টিকা পেতে যেসব দেশ নিজেরা চুক্তি করছে তাদেরও সমালোচনা করেন ডব্লিউএইচও প্রধান। তিনি বলেন, ‘কিছু দেশ ও কোম্পানি নিজেদের রাজনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক কারণে কোভ্যাক্স এড়িয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করছে।’ এইসব চুক্তি ভ্যাকসিন বৈষম্য বাড়ার ঝুঁকি তৈরি করছে বলে জানান তিনি। ড. টেড্রোস বলেন, ‘ভ্যাকসিন সরবরাহের এই ঘাটতি ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের দিকে ধাবিত করছে।’
ভ্যাকসিন বৈষম্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে চোট পড়বে
এদিকে ভ্যাকসিন থেকে দরিদ্র দেশ বঞ্চিত হলে ক্ষতির মুখে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি। এতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা উন্নয়শীল দেশগুলোর মতো উন্নত দেশগুলোতেও লাগবে বলে অতীতের কয়েকটি গবেষণা জানিয়েছিল। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ধনী দেশগুলো তাদের শতভাগ নাগরিককে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে পারবে। অথচ তখনো ভ্যাকসিনেশন থেকে অনেক দূরে থাকবে দরিদ্র দেশগুলো। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হবে। এ অংকটি জাপান ও জার্মানির সম্মিলিত বার্ষিক জিডিপির চেয়েও বড়। তবে এ ক্ষতিতে এখানে অর্ধেকের বেশি মূল্য চুকাতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রিটেনের মতো ধনী দেশগুলোকে।
গবেষকরা যেটিকে বলছেন ‘খুব সম্ভাব্য’ সেই চিত্রটি বলছে, বছর শেষে উন্নয়নশীল দেশগুলো হয়তো তাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন দিতে পারবে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিকে ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন থেকে ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়নের ধাক্কা সামলাতে হবে। এক্ষেত্রেও ধনী দেশগুলোকে অর্ধেকের বেশি ক্ষতি বহন করতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের সহায়তায় পরিচালিত গবেষণাটি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ভ্যাকসিনের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন সব দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য জরুরি, বিশেষ করে সেসব দেশ, যারা বাণিজ্যের ওপর অধিক নির্ভর করে। পাশাপাশি এটি সেই ধারণাটির সমালোচনা করে যেখানে বলা হয়, ভ্যাকসিন ভাগাভাগি করা মানে দরিদ্র দেশকে সহায়তা করা।
এ গবেষণাটির একজন গবেষক সেলভা ডেমিরালপ বলেন, স্পষ্টত সব অর্থনীতি একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। অন্য অর্থনীতিগুলোর পুনরুদ্ধার করা ছাড়া কোনো অর্থনীতিই পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
উন্নয়নশীল দেশগুলো ভাইরাসের বিস্তার থামানোর লক্ষ্যে লকডাউনের কারণে যদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে থেকে যায়, তখন তাদের হাতে খরচ করার জন্য খুব সামান্য অর্থই থাকবে। যে কারণে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার রফতানিকারকদের বিক্রি হ্রাস পাবে। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকেও ব্যাপকভাবে সংকটে পড়তে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুনাফার আগে মানুষের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। কার পকেটে কত টাকা রয়েছে, তাই যদি জীবনরক্ষাকারী ভ্যাকসিন ব্যবহারের মানদণ্ড হয়, তবে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ এই মহামারি প্রতিরোধে টিকা নিতে অসমর্থ হবে। তারা বলেন, বিজ্ঞানের অর্জন যেন মানুষের জীবনরক্ষাকারী না হয়ে শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা অর্জনের পথ না হয়। তারা বলেন, এই মহামারিটি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা, যার একটি বৈশ্বিক সমাধান প্রয়োজন। আর যতক্ষণ না পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের এই ভ্যাকসিন নেওয়ার সামর্থ্য রইবে না, ততক্ষণ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ