২০২০ সাল থেকে করোনা ভাইরাসে ধুঁকছে সারাবিশ্ব। ইতোমধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ৪১ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ এখনও চিকিৎসাধীন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শেষ হতে না হতেই বিশ্ব এখন তৃতীয় ঢেউরের আশঙ্কা করছে। টিকায় থামানো যাচ্ছে না সংক্রমণের গতি।
এর মাঝেই করোনা চিকিৎসায় সফলতার নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। সার্স কোভ-২ ভাইরাসের বেশ কিছু ধরনসহ করোনাভাইরাস গোত্রের কয়েক হাজার অভিযোজিত ভাইরাসের সংক্রমণ একাই ঠেকাতে সক্ষম অতি-শক্তিশালী একটি অ্যান্টিবডির সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে অবস্থিত ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের জৈব-রসায়নবিদ টেইলার স্টার ও তার সহকর্মী বিজ্ঞানীরা প্রথম এই সম্ভাবনাময় অ্যান্টিবডি খুঁজে পান।
নতুন আবিষ্কৃত একটি অ্যান্টিবডি সার্স কোভ-২ ভাইরাসের একাধিক ধরনের বিরুদ্ধে আরও কার্যকর টিকা আবিষ্কারের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা তাদের এ আবিষ্কার কোভিড-১৯ সহ অন্যান্য করোনা ভাইরাস সৃষ্ট রোগের চিকিৎসা ও টিকা উদ্ভাবন-উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
এ সম্পর্কিত গবেষণা নিবন্ধে এর গুরুত্ব তুলে ধরে তারা জানান, সার্স কোভ-২ এর নতুন মিউটেড ধরনগুলো বর্তমানে যে সব অ্যান্টিবডি মানবদেহে বেশিরভাগ সময় গড়ে ওঠে, অভিযোজনের মাধ্যমে সেগুলোর নাগাল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় বের করে ফেলেছে। এজন্যই কার্যকর অ্যান্টিবডির সন্ধানকে আমরা গুরুত্ব সহকারে নেই।
জানা যায়, বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণাকালে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের দেহ থেকে নেওয়া নমুনায় থাকা ১২ ধরনের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে অবস্থিত ভির বায়োটেকনোলজি নামক একটি কোম্পানির হয়ে এ গবেষণা চালান তারা।
গবেষণার জন্য সংগৃহীত অ্যান্টিবডিগুলো মানবকোষের রিসেপটরে যুক্ত হতে ভাইরাস যে প্রোটিন ব্যবহার করে তার গায়ে আবরণ তৈরির মাধ্যমে সংক্রমণ হতে সুরক্ষা দেয়। আর এটাই অ্যান্টিবডির সাধারণ সুরক্ষা।
এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে ইতোপূর্বে সার্স কোভ-২ সংক্রমণ কমাতে কয়েকটি অ্যান্টিবডি ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়। তবে বিজ্ঞানীরা আরও কার্যকর অ্যান্টিবডির সন্ধান করছিলেন।
এজন্য বিজ্ঞানীরা একটি তালিকা তৈরি করেন। এই তালিকাটি কয়েক ধরনের সার্স কোভ-২ ভাইরাসের বাইন্ডিং ডোমেইন বা কোষের গায়ে যুক্ত হওয়ার হাজার হাজার রকম অভিযোজনের। সার্স কোভ-২ এর মতোই বৈশিষ্ট্যের সার্বেকোভাইরাসেরও তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
তারপর এসমস্ত অভিযোজন কীভাবে সংগৃহীত ১২টি অ্যান্টিবডির ভাইরাসের বাইন্ডিং ডোমেইনে অ্যান্টিবডির আবরণ সৃষ্টির সক্ষমতাকে প্রভাবিত করে তার পর্যালোচনা করেন বিজ্ঞানীরা।
আর তাতেই আসে এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার। পরীক্ষানিরীক্ষার সময় বিজ্ঞানীরা এস২এইচ৯৭ নামের একটি অ্যান্টিবডিকে সব ধরনের সার্বেকোভাইরাসের অভিযোজিত ধরনের গায়ে আবরণ সৃষ্টি করতে দেখেন। এটি সার্স কোভ-২ ভাইরাসের বেশ কিছু ভেরিয়েন্টকেও ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত সুস্থ মানবকোষে বিস্তার থেকে রক্ষা করে।
বিজ্ঞানীরা প্রাণীদেহেও গবেষণা চালান। হ্যামস্টার (ইঁদুর গোত্রীয়) কিছু প্রাণীকে এই অ্যান্টিবডি দেওয়ার পর তারা সার্স কোভ-২ সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। যা অ্যান্টিবডির শক্তিশালী দিকটি তুলে ধরে।
এ প্রসঙ্গে জৈব-রসায়নবিদ টেইলার স্টার বলেন, একেই আমরা সবচেয়ে অভিভূতকারী অ্যান্টিবডি হিসেবে বর্ণনা করেছি।
এস২এইচ৯৭ এর আণবিক গঠন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেন, ইতোপূর্বে অজানা ও অদেখা বাইন্ডিং ডোমেইনের একটি গুপ্ত অংশকে টার্গেট করে এ অ্যান্টিবডি।
ভাইরাস রিসেপ্টরের এ অংশ শুধুমাত্র কোষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সময়েই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায়, সেজন্যেই এতদিন এ বিষয়টি অন্যান্য গবেষকদের নজরে আসেনি।
সুপার অ্যান্টিবডিগুলি করোনা ভাইরাসের সব প্রজাতির ওপরই কাজ করে। এটি ভাইরাসকে নিউট্রিলাইজ বা প্রশমিত করে দেয়। ফলে দেহকোষে ঢুকেও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কোভিড।
টেইলার স্টার আরও বলেন যে, এস২এইচ৯৭ এর আণবিক কণা বা মলিকিউল- একাধিক ধরনের ভাইরাসের কোষে সংযুক্ত হওয়ার ওই অংশকে প্রতিরোধ করতে পারে।
গবেষণায় অন্য ১১টি অ্যান্টিবডির কিছু মাত্রার সক্ষমতা প্রমাণিত হলেও, এগুলোর সফলতা বেশি সার্স কোভ-২ ভাইরাসের প্রথম দিকের ধরনগুলোর অনুপ্রবেশ ঠেকানোর ক্ষেত্রে।
এস২এইচ৯৭ সেদিক দিয়েও অনন্য; কারণ এটি একইসাথে ভাইরাসের নতুন ও বিপজ্জনক ধরন ঠেকাতে সমান কার্যকর।
এ ব্যাপারে কানাডার সাসকাটনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচেওয়ান’র ভাইরোলজিস্ট অরিঞ্জয় ব্যানার্জি বলেন, এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আনন্দের।
তবে কিছু শঙ্কা থেকেই যায়, যেমন কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী ও এখন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত নতুন ধরনের বিরুদ্ধে এটি কতোটা কার্যকর হবে- তা এখনও অজানা।
তবে অরিঞ্জয় মনে করেন, নতুন এ আবিষ্কার করোনা ভাইরাস গোত্রের পরিচিত ধরনগুলো প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কার ও চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়নে সম্ভাবনার নয়া-দিগন্ত যুক্ত করবে। আগামী দিনে যা প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দারুণ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের মতে, সুপার অ্যান্টিবডিগুলি করোনা ভাইরাসের সব প্রজাতির ওপরই কাজ করে। এটি ভাইরাসকে নিউট্রিলাইজ বা প্রশমিত করে দেয়। ফলে দেহকোষে ঢুকেও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কোভিড।
সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি স্টাডিতে গবেষক ফিল নাডিউ বলেছেন, ‘বর্তমানে কোনো রোগীর দেহে করোনার কোনো প্রজাতি বাসা বেঁধে রয়েছে তা চিকিৎসকদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যতক্ষণ না জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে। কিন্তু যদি এই ধরনের অ্যান্টিবডি ট্রিটমেন্ট করা যায় সেক্ষেত্রে কোভিডের যে কোনও প্রজাতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সফল হবে এটি।’
ইতোমধ্যে মার্কিন সরকার এবং বিশ্বের একাধিক দেশ এই চিকিৎসাকে কার্যকরি বলে মনে করছে। যে সব কোভিড রোগীর উপসর্গ গুরুতর এবং প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে, তাঁদের দেহে এই চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
গবেষকদের মতে, বিশ্বে যেসব ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়েছে সেগুলি করোনার নির্দিষ্ট কিছু প্রজাতির ওপর ভিত্তি করেই। কিন্তু আরএনএ ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই টিকা আদৌ কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে কোভিড টিকার দুটি ডোজ নিয়েও ফের করোনা আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ