করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রেমডিসিভির কার্যত কোনো কাজ করে না বলে জানিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। রেমডিসিভির ব্যবহার না করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশও করেছিল। সেসব অমান্য করেই বাংলাদেশে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় অহরহ রেমডিসিভির ব্যবহার করা হচ্ছে।
করোনা মহামারি চিকিৎসায় রেমডিসিভিরের কার্যকারিতা সাড়া ফেলে বিশ্বজুড়ে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও এই ওষুধ ব্যবহারে জোর দিয়েছিলেন। করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় মে মাসে প্রথম রেমডিসিভির ব্যবহার করা হয়।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রাথমিক বিশ্লেষণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় রেমডিসিভিরের কার্যকারিতা শূন্য বা একেবারেই সামান্য। কোভিড রোগীদের হাসপাতালে থাকার মেয়াদ কমাতে ব্যর্থ এই ওষুধ। রেমডিসিভি প্রয়োগে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
একইভাবে করোনা আক্রান্তদের মৃত্যু ঠেকাতেও কোনো কাজ করছে না রেমডিসিভির।
এরপরেই কোভিড- ১৯ চিকিৎসায় ‘রেমডিসিভির’ ওষুধ বাতিল করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা- ডব্লিউএইচও। বেশ কয়েকটি পরীক্ষার পর্যালোচনার ভিত্তিতে ওষুধটি রোগীদের সুস্থ করে তুলতে পারে না বলে জানায় সংস্থাটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, এই মেডিসিনের কোন কার্যকারিতা নেই। কোভিড -১৯ চিকিৎসায় রেমডিসিভির ব্যবহার না করতে পরামর্শও দিয়েছে ডব্লিউএইচও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার একদল বিশেষজ্ঞ বিএমজি’এর এক প্রতিবেদনে জানান, ‘রেমডিসিভির প্রয়োগে শেষ পর্যন্ত কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। রোগীদের উপরে প্রয়োগে পরও সুস্থতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
তারা আরো জানায়, করোনার চিকিৎসার জন্য রোগীদের ‘রেমডিসিভির’ দেওয়া যাবে না। কারণ এই ওষুধ ব্যবহারে করোনায় মৃত্যুর হার কমেছে বা রোগীদের ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন কমেছে বলে এমন কোনও প্রমাণ নেই।
রেমডিসিভির ব্যবহার না করার জন্য ডব্লিউএইচও এর সুপারিশ সত্ত্বেও বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় অহরহ রেমডিসিভির ব্যবহার করা হচ্ছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রেমডিসিভির ব্যবহার করলে অনেক সময় ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া রেমডিসিভির দেশীয় ওষুধ কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধ বলে অনেক সময় ওষুধ কোম্পানিগুলোর ‘পুশ সেলিং’ বিক্রয় কৌশলের কারণে ও রোগীদের স্বজনদের চাপেও রেমডিসিভির ব্যবহার করেন চিকিৎসকেরা।
বাংলাদেশে প্রতি ভায়াল রেমডিসিভিরের দাম ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। একেকজন রোগীকে ৫ থেকে ১০টি ভায়াল দেয়া হয়। এতে রেমডিসিভিরে রোগীর ব্যয় ৬০ হাজার টাকার বেশি হয়।
ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউয়ের অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট ডা. অনিরুদ্ধ এক দৈনিককে বলেন, ‘কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এখনো অক্সিজেন ও ব্লাড থিনার ছাড়া নির্দিষ্ট কোন ওষুধ নেই। রেমডিসিভির সাধারণত ব্যবহার করা হয় না। রোগীর প্রাথমিক পর্যায়ে ভাইরাল লোড যখন বাড়তে থাকে তখন রেমডিসিভির ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়’।
ডা. অনিরুদ্ধ বলেন, ‘আমরা ডব্লিউএইচও ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রটোকল অনুযায়ী রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছি। তারপরও অনেক সময় রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী রেমডিসিভির ব্যবহার করা হয়। ডব্লিউএইচও কিছু দিন পর পর প্রটোকল পরিবর্তন করে; ডব্লিউএইচও এর প্রটোকলে নেই এমন ওষুধ ব্যবহার করেও আমরা ভালো ফল পাচ্ছি’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ওই দৈনিককে বলেন, ‘আমাদের দেশে অহরহ রেমডিসিভির ব্যবহার করা হয়। ওষুধটি দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে তাই পুশ সেলিংয়ের কারণে অনেক সময় অপ্রয়োজনেও এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি অনেক সময় রোগীর স্বজনেরাও ওষুধটি দিতে বলে। মিডিয়ার কল্যাণে সবাই রেমডিসিভিরের নাম জানে তাই রোগীর অবস্থার অবনতি হলেই স্বজনেরা রেমডিসিভির দিতে বলে’।
চিকিৎসকেরা বলেন, কোভিড চিকিৎসার জন্য মৌলিক প্রটোকল অনুসরণ করা হয়। কোন রোগীকে কখন অক্সিজেন, স্টেরয়েড দেয়া হবে তা সেভাবেই মানা হয়। তবে গাইডলাইনের বাইরে গিয়েও অনেক সময় রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ফার্মাকোলজিকাল সোসাইটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘ডব্লিউএইচও এর প্রটোকল ভলান্টিয়ারি বা ঐচ্ছিক প্রটোকল। সবাই এটি মানতে বাধ্য থাকবে তা নয়। রেমডিসিভির ব্যবহারের ক্ষেত্রে টাইমিং অনেক জরুরি। চিকিৎসকেরা যদি রোগীর উপকারের জন্য কোন ওষুধ ব্যবহার করে তাহলে কোন সমস্যা নেই’।
রেমডেসিভির ওষুধটির পেটেন্ট যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বায়োফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি গিলিয়াড সায়ন্সেস-এর। ওষুধটি প্রথমে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, নভেল করোনাভাইরাস সহ আরো কিছু ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে যেভাবে বংশবৃদ্ধি করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, সেই প্রক্রিয়াটি কিছুটা হলেও থামানোর সক্ষমতা রয়েছে এই ওষুধের।
কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় এই ওষুধ কার্যকর হতে পারে, এমন গবেষণার তথ্য গিলিয়াড সায়ন্সেস প্রকাশ করার পর করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জরুরি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এই ওষুধ ব্যবহারের অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।
বলা হচ্ছে, এই ওষুধের প্রয়োগ বেশী অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে থাকার সময়কাল চার দিন পর্যন্ত কমাতে পারে।
রেমডেসিভিরের পেটেন্টের মালিকানা গিলিয়াড সায়ন্সেস-এর, অর্থাৎ শুধুমাত্র তাদেরই এই ওষুধ তৈরির অধিকার রয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নাম থাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি অনুযায়ী এই ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে ওই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের ওপর প্রযোজ্য হবে না। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর ওষুধ রেমডেসিভির উৎপাদন সম্পন্ন করেছে দেশের খ্যাতনামা ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
রেমডেসিভির উৎপাদনের একচেটিয়া স্বত্ব রয়েছে গিলিয়েডের। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন অনুযায়ী, জাতিসংঘ স্বীকৃত বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো এসব পেটেন্ট বা স্বত্ব অগ্রাহ্য করতে পারে। ফলে এসব দেশ সহনীয় মূল্যে ওষুধ উৎপাদন করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩১
আপনার মতামত জানানঃ