অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা সংস্থার গবেষণালব্ধ করোনার টিকা তৈরি করছে ভারতের পুনের সেরাম ইনস্টিটিউট। নিজ দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকা সরবরাহের চুক্তি করলেও সেরাম প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকা উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে ভারতে যেমন সব রাজ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকার ডোজ সরবরাহ করতে পারছে না কোম্পানিটি অপর দিকে বিশ্বের অন্য দেশগুলোও সময় মতো চুক্তি অনুযায়ী টিকা পাচ্ছে না। বিদেশে টিকা সরবরাহে দেরি হওয়ায় ভারতের টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ফার্মাসিউটিক্যালস।
জানা যায়, কোম্পানিটির টিকা সরবরাহের জন্য সিরামের উপর নির্ভর করছে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ। এদিকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে ভারত সরকার। ভারতকে প্রাধান্য দিয়ে তারপর বিদেশে টিকা পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে সেরাম ইনস্টিটিউট। এ নিয়েই তৈরি হয়েছে সমস্যা।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা থেকে লাইসেন্স নিয়ে কোভিড-১৯ টিকা— কোভিশিল্ড নামে উৎপাদন ও বাজারজাত করছে সেরাম। গত মঙ্গলবার সেরামের মুখ্য নির্বাহী আদর পুনেওয়ালা স্বীকার করেন যে, তার সংস্থার বিদ্যমান উৎপাদন সক্ষমতা ‘প্রচণ্ড চাপে’র মধ্যে আছে। এর একদিন পরই গতকাল বুধবার আইনি নোটিশের সংবাদ প্রকাশ করে প্রথমসারির ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি।
ভারতের সংবাদমাধ্যমে সেরামের প্রধান আদর পুনাওয়ালা বলেছেন, ‘ভারত সরকার এই আইনি নোটিশের বিষয়ে বিস্তারিত জানে। এটি গোপন একটি নোটিস, এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারব না। তবে সরকারের সাহায্যে আইনি জটিলতা কাটানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভারতে সরবরাহের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণেই অন্য দেশে সরবরাহে দেরি হচ্ছে। আশা করি দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।’
আদর জানিয়েছেন, প্রতি মাসে ছয় কোটি থেকে সড়ে ছয় কোটি টিকা তৈরি করতে পারে সেরাম। প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত ১০ কোটি টিকা ভারতে সরবরাহ করেছে আর ছয় কোটি টিকা বিদেশে পাঠিয়েছে।
পুনেওয়ালা জানান, ভারত সরকার দেশের বাইরে কোভিশিল্ডের বড় চালান রপ্তানি স্থগিত করেছে, তার পাশাপাশি স্থানীয় কোম্পানি হিসেবে সেরামের সঙ্গে ‘প্রথম অধিকারের’ ভিত্তিতে যে চুক্তি তারা করেছে- সেটি বিদেশী পক্ষগুলো বুঝতে চাইছে না।
তিনি বলেন, ভারতকে প্রাধান্য দেয়ার ফলে টিকা ঘাটতি পড়ার বিষয়টি অন্য দেশগুলোকে বোঝানো সমস্যাজনক। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যদি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হয়, তাহলে আরও প্রায় তিন হাজার কোটি রুপির বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু ভারতে সরকারকে ভর্তুকিতে টিকা বিক্রি করতে হচ্ছে, এতে দাম পড়ছে ১৫০ থেকে ১৬০ রুপি। অন্য দিকে বিদেশে এই ভ্যাকসিন বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার রুপিতে।
আদরের বক্তব্য, প্রতি টিকায় সামান্য লাভ করে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এই বিপুল বিনিয়োগ জোগাড় করা সম্ভব নয়। সে কারণে হয় ঋণ করতে হবে অথবা বড় কোনও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই একমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
মজুত থাকা করোনা টিকা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে বলে ভারতের বেশ কিছু রাজ্য সম্প্রতি অভিযোগ করেছে। টিকা প্রয়োগে ঘাটতি তৈরি হতে পারে বলে গতকাল বুধবার জানিয়েছেন মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ তোপে। বুধবার রাতে রাজ্যের সাতারা জেলায় ভ্যাকসিনের ডোজ শেষ হয়ে যাওয়ায় গত ৩ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে টিকা প্রয়োগ।
এদিকে টিকার উৎপাদন বাড়িয়ে বিদেশে রপ্তানি জারি রাখতে পুনের সেরাম ইনস্টিটিউটের ৩ হাজার কোটি রুপি প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আদর পুনাওয়ালা গত মঙ্গলবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যেভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তা রুখতে গেলে যত বেশি সম্ভব মানুষকে টিকা দেওয়া প্রয়োজন। জুন–জুলাই মাসের মধ্যেই তা করতে হবে। সে জন্য দরকার উৎপাদন বাড়ানো। তার জন্য প্রয়োজন ৩ হাজার কোটি রুপি।
আদর পুনেওয়ালা বলেন, টিকার উৎপাদন নিয়ে তার সংস্থা অত্যন্ত চাপের মুখে রয়েছে। উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন দেশবাসীকে টিকা দেওয়া ও বিদেশে রপ্তানির জন্য। উৎপাদনক্ষমতা না বাড়ালে তা সম্ভব নয়।
এদিকে ভারতে নতুন করে সংক্রমণের ছবি দিন দিন মারাত্মক আকার নিচ্ছে। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের জেরে সোমবার প্রথমবারের জন্য আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল ১ লাখ। মঙ্গলবার তা একটু কমেছিল। বুধবার হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার, আর বৃহস্পতিবারে ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৮৯ জন।
স্থানীয় গণমাধ্যম বলছে, দেশটিতে একদিনে আক্রান্তের নিরিখে এই সংখ্যা এখনো অবধি সর্বোচ্চ।
টিকা কেন্দ্রগুলোয় উপচে পড়ছে ভিড়। এখন ৪৫ ঊর্ধ্বদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই দিল্লি ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীরা দাবি করেছেন, ১৮ বছরের বেশি প্রত্যেককে অবিলম্বে টিকা দেওয়া হোক।
এ নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্কও। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষণ মঙ্গলবার বলেন, যাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তাদেরই প্রথমে টিকা দেওয়া হচ্ছে। জুলাই পর্যন্ত এমন চলবে। কারণ, পর্যাপ্ত টিকা নেই।
নীতি আয়োগের সদস্য ভি কে পল আবার এক ধাপ এগিয়ে বলেন, সময়ে সবাইকে টিকা দেওয়া হবে।
সরকারের এই মনোভাবের প্রতিবাদ করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। বুধবার এক টুইটে তিনি সরকারকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘টিকা কারা চান ও কাদের প্রয়োজন, সেই বিতর্ক হাস্যকর। প্রত্যেক ভারতীয়র নিরাপদ জীবন পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’
এই পরিস্থিতিতে বিপদ–ঘণ্টি বাজিয়েছেন মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ টোপে। তিনি বলেছেন, রাজ্যে যা টিকা মজুত রয়েছে, তাতে বড়জোর তিন দিন চলবে। দ্রুত টিকা পাঠানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। মহারাষ্ট্রের হাল সবচেয়ে খারাপ। দেশে সংক্রমণের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে শুধু এই রাজ্যে।
সংক্রমণ রুখতে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা নতুন করে বিভিন্ন রাজ্যে জারি করা হচ্ছে। জোর দেওয়া হচ্ছে মাস্ক পরা ও ভিড় এড়ানোর ওপর। দিল্লি হাইকোর্ট গতকাল বুধবার এক মামলায় জানিয়েছে, নিজের গাড়িতে একাকী সফর করলেও মাস্ক পরতে হবে। না পরলে জরিমানা। বিচারকের নির্দেশে এই অতিমারির সময় নিজস্ব গাড়িও ‘পাবলিক প্লেস’ হিসেবে গণ্য হবে। টিকা নেওয়া থাকলেও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গতকাল বুধবার সকাল সাতটা পর্যন্ত দেশে মোট ৮ কোটি ৭০ লাখ ৭৭ হাজার জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। সরকারি দাবি, এত দ্রুত এত মানুষকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে ভারত এখন ১ নম্বরে।
পুনেওয়ালা জানিয়েছেন, তারা রাশিয়ার টিকা ‘স্পুটনিক–ভি’ উৎপাদনে এগোচ্ছেন। ‘কোডাজেনিক্স’ নামে একটা প্রতিষেধকের ট্রায়ালও খুব শিগগির শুরু হবে। ওই টিকা ইনজেকশন নয়, নাকের ড্রপ। কিন্তু কোভিডের মোকাবিলায় তা ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে ভারত সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার রপ্তানি সাময়িকভাবে স্থগিত করার পর সময়মত টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, টিকার পরের চালান কবে বাংলাদেশ হাতে পাবে, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন তিনি। সময়মত টিকা না পেলে চলমান টিকাদান কর্মসূচিতেও এর প্রভাব পড়বে। টিকার এই সংকট কাটাতে অন্যান্য উদ্ভাবকদের কাছ থেকে টিকা কেনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার। এ জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, এসব উদ্যোগে এখনও সাড়া মেলেনি। তবে টিকার বিকল্প উৎস পাওয়া যাবে বলে তিনি আশাবাদী।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ