করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে পুরো ইউরোপ ও আরও ১২টি দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও যুক্তরাজ্য এই তালিকায় নেই। অর্থাৎ যুক্তরাজ্য বাদে ইউরোপসহ আরও ১২ দেশ থেকে যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তবে এবার বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
শুক্রবার এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে আগামী ৯ এপ্রিল ভোর ৪টা থেকে এ আদেশ কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে দেশটির ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, পাকিস্তান ও কেনিয়াকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে ব্রিটিশ, আইরিশ ও বাংলাদেশি ছাড়া অন্য দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তাদের যুক্তরাজ্য সরকার নির্ধারিত হোটেলে ১০ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
নতুন করে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় এই দেশগুলোকে যুক্ত করার ফলে যুক্তরাজ্যের লাল তালিকাভুক্ত দেশের সংখ্যা এখন ৩৯ এ দাঁড়াল। ভ্যাকসিন-প্রতিরোধী ভাইরাসের কোনো ধরন যেন যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্যই এই পদক্ষেপ নেয়া নিয়েছে দেশটি।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সরকার এটি বারবার পরিষ্কার করে করেছে যে, ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এই গন্তব্যগুলি লাল তালিকায় যুক্ত করা হলো।’
এসব দেশ থেকে কেউ যুক্তরাজ্যে এলে তাকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। তবে কোনো ব্রিটিশ নাগরিক এই দেশগুলো থেকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করলে তাকে অবশ্যই হোটেলে ১০ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
ব্রিটিশ মন্ত্রীরা ফ্রান্স ও জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশগুলোকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হননি। এসব দেশে বর্তমানে করোনার তৃতীয় ঢেউ চলছে।
এদিকে বাংলাদেশও যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের সব দেশ থেকে এবং আরও ১২টি দেশ থেকে যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) গত বুধবার (৩১ মার্চ) এক বিজ্ঞপ্তিতে ওইসব দেশ থেকে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ করে।
বিজ্ঞপ্তিতে বেবিচক জানায়, ৩ এপ্রিল থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। বহাল থাকবে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত। যেসব দেশ থেকে যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ইউরোপের দেশগুলো ছাড়াও আছে— আর্জেন্টিনা, বাহরাইন, ব্রাজিল, চিলি, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, পেরু, কাতার, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক ও উরুগুয়ে।
অর্থাৎ, যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে যাত্রীরা প্রবেশ করতে পারলেও বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে কোনো যাত্রী প্রবেশ করতে পারবে না।
ফেব্রুয়ারিতে নতুন স্ট্রেইনের বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে জানুয়ারি থেকে যুক্তরাজ্যে নভেল করোনাভাইরাসের নতুন ধরনটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। নভেম্বরে দেশটিতে লকডাউন চলাকালেও ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাসটির নতুন ধরন। এর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় তৃতীয়বারের মতো লকডাউন ঘোষণা করা হয় জানুয়ারিতে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা অন্য সব স্ট্রেইনের তুলনায় যুক্তরাজ্যের স্ট্রেইনটিকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন। নতুন ধরনটি হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি বাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য স্ট্রেইনের তুলনায় ইউকে স্ট্রেইনটি ৩৫-৪৫ শতাংশ বেশি তাড়াতাড়ি সংক্রমিত হয়েছে।
জানুয়ারিতে বাংলাদেশে করোনার নতুন এ স্ট্রেইন শনাক্ত হয়। কিন্তু তা প্রকাশ পায় মার্চে। যুক্তরাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকেই এটি শনাক্ত হয়। মার্চে এমন ঘোষণার পরপরই দেশে করোনার সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে।
এদিকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দর থেকে ৮৩ জন যাত্রী নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট আন্তর্জাতিক ওসমানী বিমানবন্দরে অবতরণ করে। যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে আসা ৮৩ জনকে বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। তারা সরকারনির্ধারিত হোটেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকবেন।
সিলেট বিমানবন্দর ও মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, গতকাল সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে যুক্তরাজ্য থেকে ৮৩ যাত্রী সিলেট আন্তর্জাতিক ওসমানী বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। পরে বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটের দিকে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শেষে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সব যাত্রীকে ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের হোটেলগুলোয় পাঠানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে করোনার ছড়াছড়ি বয়ে যাওয়া যুক্তরাজ্য থেকে লোকজন আসা অব্যাহত থাকলে যুক্তরাজ্য থেকে করোনাও আমদানি হবে। ইতিমধ্যে সিলেটে গত তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) এক দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৯৪ জনের। এর আগে গত সোমবার এক দিনে সর্বোচ্চ করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল ৮৬ জনের। এছাড়া নতুন ধরনের স্ট্রেইনও সিলেট হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে। যুক্তরাজ্য থেকে যাত্রী আসা বন্ধ না হলে এমনটি বাড়তেই থাকবে।
তারা বলেন, আমাদের দেশে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। আবার যদি এখন ইউকে থেকে আসা শুরু করে আরও ছড়াবে। তারপরও আমরা দরজা খুলে রেখেছি আসার জন্য। সিভিল এভিয়েশন এটা কী করলো বোধগম্য নয়!এসব সিদ্ধান্তের কোনও যৌক্তিকতা নেই। যখন ইউকে বন্ধ করার দরকার ছিল, আমরা করলাম না। সেটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা ন্যূনতম ৫০ ভাগ সংক্রমণ হচ্ছে ইউকে ভ্যারিয়েন্টের কারণে।
সরকার নির্ধারিত হোটেলগুলোতে যুক্তরাজ্য ফেরত যাত্রীদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন চলছে। সেখানকার অববস্থাপনা নিয়ে বলেন, এর আগেও সরকার নির্ধারিত স্থানে কোয়ারেন্টিন থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে। করোনার টেস্ট ঠিকভাবে না করা, সনদপত্র ভালো করে না দেখেই যাত্রী ছেড়ে দেওয়া ও অর্থের বিনিময়ে কোয়ারেন্টিন সেন্টার থেকে যাত্রী ছেড়ে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। গতকালও সিলেট নগরীর একটি আবাসিক হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এক নারীকে (৩৬) উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ উঠেছে। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এমন অব্যবস্থাপনার মধ্যে করোনা রোধে তেমন কোনো ফল দেবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৪
আপনার মতামত জানানঃ