ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে আসার প্রাক্কালে বেশ কিছু ঘটনায় উত্তেজনা ছড়াচ্ছে দু’দেশেই। মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ জানাচ্ছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলো। তিস্তার পানি বন্টন, সীমান্ত হত্যার সহ বেশ কিছু ইস্যুতে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এদিকে এ সময়ই আগ্রাসী হয়ে উঠেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সিলেটের জুড়ি সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশীকে যুবককে হত্যা করে লাশ নিয়ে উল্লাস করার পর এবার ২শ’ বছরের পুরনো মসজিদ পুনর্নির্মাণের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ।
সীমান্তে বিরাজ করছে যুদ্ধাবস্থা
সিলেটের বিয়ানীবাজারের গজুকাটা সীমান্তে ২০০ বছরের প্রাচীন মসজিদ পুনর্নির্মাণে বাধা দিয়ে নো ম্যানস ল্যান্ডে বাঙ্কার বসিয়ে অবস্থান নিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। সীমান্তে বিএসএফের এ অবস্থানের কারণে পাল্টা অবস্থান নিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
এ নিয়ে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার গজুকাটা সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। গত দুই দিন থেকে সীমান্ত এলাকায় এই অবস্থা বিরাজ করলেও সোমবার দিনভর ভারতীয় বাহিনী জিরো লাইনের ভেতরে প্রবেশ করে শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি ভারি অস্ত্র মজুদ করেছে।
বিজিবিও মসজিদ নির্মাণে বাধা দেয়া ও ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসী ভূমিকার জবাব দিতে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। সীমান্ত এলাকা জুড়ে তারাও শক্তি বৃদ্ধি করেছে।
সব মিলিয়ে দু’পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আতঙ্কিত অনেকে ইতোমধ্যে পরিবার নিয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান নিয়েছেন।
এদিকে, বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল মো. শাহ আলম সিদ্দিকি জানিয়েছেন, ভারতীয় বাহিনী জিরো লাইনের ১৫০ গজের ভেতরে প্রবেশ করে কোন ধরণের বাধা প্রদান করতে পারে না। তারা সীমান্ত আইন লংঘন করে ২শ’ বছরের পুরনো মসজিদ পুনর্নির্মাণে বাধা প্রদান করেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে বিএসএফের অবস্থানের কারণে বিজিবিও সীমান্তে অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি সমাধানে আজ বিকেল ৫টায় পতাকা বৈঠক বসবে।’
দ্বন্দ্বের সূত্রপাত
জানা যায়, বিয়ানীবাজার উপজেলার গজুকাটা সীমান্ত এলাকার ১৩৫৭ নং পিলারের ভেতরে বাংলাদেশ অংশে গজুকাটা গ্রামের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ২শ’ বছরের পুরনো পাকা ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এলাকার মুসল্লিরা এ অবস্থায় মসজিদের ভেতর নামাজ আদায় করছেন।
মুসল্লিরা জানান, অনেক বছর আগে একজন ইঞ্জিনিয়ার ভবনের জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে মসজিদের ভেতর প্রবেশ কিংবা নামাজ আদায় থেকে বিরত থাকার জন্য মুসল্লিদের অনুরোধ করেন। তারপর এলাকাবাসী মসজিদের পাশের ঈদগাহে নতুন মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনাও গ্রহণ করেন।
দুবাগ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আফতাব উদ্দিন বলেন, ২০১৮ ইং সনে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রামবাসী নেওয়ার পর তারা বিজিবি’র সহায়তা চান। তৎকালীন বিজিবি-৩২ ব্যাটলিয়ানের কমান্ডার বিএসএফ’র কমান্ডারের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হলে তারা নির্মাণ কাজ শুরু করেন।
কিন্তু নির্মাণ কাজের নিচ অংশের পিলার-লিন্টারসহ আনুষাঙ্গিক কাজ শেষে ছাদ ঢালাইয়ের জন্য প্রস্তুতির এক পর্যায়ে বিএসএফ সরাসরি বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে মসজিদ নির্মাণ কাজে বাধা প্রদান করে।
শুরুতে আপত্তির কথা জানায়নি বিএসএফ
এদিকে দীর্ঘ ৩ বছর পর গত সাপ্তাহে বিজিবি-৫২’র সাথে বিএসএফ’র বৈঠকে মসজিদটি পুনর্নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা হয় এবং তা পুনর্নির্মাণ করতে
বিএসএফ বাধা প্রদান করবে না বলে আশ্বস্থ করে। কিন্তু এলাকাবাসী প্রবাসীদের সহযোগিতা নিয়ে মসজিদ নির্মাণের সকল প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করলে শনিবার বিকেলে বিএসএফ তাতে বাধা প্রদান করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ নিয়ে বিজিবি’র পক্ষ থেকে পতাকা বৈঠকের আহবান জানালেও বিএসএফ তাতে পাত্তা না দিয়ে সীমান্ত এলাকায় শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাংকার খনন করে শক্ত অবস্থান নেয়। বিজিবি পাল্টা অবস্থান নিয়ে তাদের জবাবের প্রস্তুুতি নিয়ে সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করছে।
বর্তমান পরিস্থিতি
বিএসএফ জিরো লাইনের ১৫০ গজের মধ্যে ব্যাংকার খনন করে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তারা শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি টহলও বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি ৫২ ব্যাটলিয়ান তাদের অবস্থান আরো দৃঢ় করে জবাবের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
মসজিদের ইমাম হাফিজ বিলাল আহমদ জানান, বিএসএফ এর বাধার পর থেকে নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে এলাকাবাসী জানিয়েছেন, যে কোন মূল্যে এবার তারা মসজিদ নির্মাণ করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
দুবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম বলেন, ২শ’ বছরের প্রাচীন এই মসজিদ নির্মাণ কাজে আমাদের সহযোগিতা রয়েছে। বিএসএফ মসজিদ নির্মাণ কাজে বাধা প্রদান ও নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়ার সংবাদ আমাদেরকে মর্মাহত করেছে। ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে বিজিবি-৫২’র কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল মো. শাহ আলম সিদ্দিকি জানিয়েছেন, বিএসএফ সীমান্তের ১৫০ গজের ভেতর মসজিদ নির্মাণ কাজে কোন ক্রমেই বাধা প্রদান করতে পারেন না। বিএসএফ এখানে বাঁধা দিয়ে অন্যায় করছে।
তিনি বলেন, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে যে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে তারা প্রস্তুত রয়েছেন। তিনি জানান, গজুকাটা সীমান্তসহ তার আওতাধীন সকল এলাকায় বিজিবি’র শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিজিবি-৫২’র কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল মো. শাহ আলম সিদ্দিকি জানিয়েছেন, বিএসএফ সীমান্তের ১৫০ গজের ভেতর মসজিদ নির্মাণ কাজে কোন ক্রমেই বাধা প্রদান করতে পারেন না। বিএসএফ এখানে বাঁধা দিয়ে অন্যায় করছে।
তবে সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লুৎফর রহমান (গণমাধ্যম) বলেন, বিয়ানীবাজারের সীমান্ত এলাকায় বিজিবি-বিএসএফের কোনও ঘটনা জানা নেই।
আগেও একবার অবৈধভাবে বাধা দেয় বিএসএফ
এর আগে ২০১৮ সালেও মসজিদটির পুনর্নির্মাণে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাধা দিয়েছিল। বিএসএফের বাধার মুখে বিয়ানীবাজার উপজেলার গজুকাটা সীমান্ত এলাকার ওই জামে মসজিদের পুনর্নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায় তখন।
মসজিদ নির্মাণকাজের নিচ অংশের পিলার-লিন্টারসহ আনুসঙ্গিক কাজ শেষে ছাদ ঢালাইয়ের জন্য প্রস্তুতির একপর্যায়ে বিএসএফ সরাসরি বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে মসজিদ নির্মাণ কাজে নিষেধ দিয়ে চলে যায়।
মসজিদের ইমাম হাফিজ বিলাল আহমদ জানান, বিএসএফের বাধার পর থেকে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। কাজ বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ২ শতাধিক বস্তা সিমেন্ট ও কয়েকশ ফুট বালু নষ্ট হয়ে গেছে।
বাংলাদেশীর লাশ উদ্ধার নিয়ে উত্তেজনা
এদিকে সোমবার বিকেলে মৌলভীবাজারের জুড়ী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত বাংলাদেশী বাপ্পার লাশ হস্তান্তর করেছে বিএসএফ। নিহতের ৪ দিনের মাথায় বিজিবি’র উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে ভারতীয় বাহিনী লাশ হস্তান্তরে বাধ্য হয়।
গত শনিবার ভোরে উপজেলার ফুলতলা ইউনিয়নের পূর্ব বটুলী এলাকায় কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে বিএসএফ বাপ্পার বুকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর বিএসএফ বাপ্পার লাশ নিয়ে উল্লাস করে।
সীমান্ত সূত্র জানায়, বাপ্পাকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। তার বুকের মধ্যে গুলি বিদ্ধ হওয়ায় বিএসএফ এ নিয়ে প্রতিবাদের মুখে পড়বে এই আশংকায় লাশ গুম করে রাখে। পরে বিজিবি’র শক্ত অবস্থানের পর সোমবার বিকেলে লাশ হস্তান্তর করতে বাধ্য হয় বিএসএফ।
এ প্রসঙ্গে জানতে বিজিবি-৫২’র কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল মো. শাহ আলম সিদ্দিকি’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সোমবার বিএসএফ বাপ্পার লাশ হস্তান্তর করেছে। তার বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি প্রাথমিক ভাবে নিশ্চিত হয়েছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮১৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ