করোনা মহামারিতে দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অঞ্চলে দুই লাখ ৩৯ হাজার মা ও শিশুর মৃত্যুর জন্য একে কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে শিশুর মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ২৮ হাজার এবং ১১ হাজার মাতৃমৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘের নতুন এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। ইউনিসেফের উদ্যোগে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডাব্লিউএইচও) এবং ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড (ইউএনএফপিএ)-এর সহযোগিতায় প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডিরেক্ট অ্যান্ড ইনডিরেক্ট ইফেক্টস অব কোভিড-নাইনটিন প্যান্ডেমিক অ্যান্ড রেসপন্স ইন সাউথ এশিয়া’। ওই প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যসুরক্ষা, স্কুলসহ বিভিন্ন সমাজসেবা কার্যক্রম এবং অর্থনীতি নিয়ে সরকার যেসব কৌশল নিয়েছিল তার প্রভাব খতিয়ে দেখা হয়েছে।
ভেঙে পড়েছে এ অঞ্চলের স্বাস্থ্যব্যবস্থা
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই কঠোর লকডাউন আরোপ করে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করেছিল, এখনও করছে। হাসপাতাল, ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান ছাড়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারি রুখতে ক্লিনিকগুলো ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। যার আওতায় মা ও শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম ছিল। এই সময় করোনা রোগীর চিকিৎসায় ক্লিনিকগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।
নেপাল ও বাংলাদেশে মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা ৮০ শতাংশ শিশু শৈশবকালীন টিকাদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যার স্পষ্টত নজির ভারত-পাকিস্তানেও পাওয়া গেছে।
মহামারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার ৪২০ মিলিয়ন শিশুর বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ ছিল। এর পরবর্তী প্রভাব হিসেবে প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, সাড়ে চার মিলিয়ন মেয়ে কখনও স্কুলে ফিরে যাবে না। একইসঙ্গে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য এবং তথ্য পরিষেবাদির অবনতির কারণে ঝুঁকিতে আছে এসব শিশুরা।
দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি জনবহুল দেশের (আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা) প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মহামারিজনিত কারণে বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যসেবাদান আরও ব্যহত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয় এ ছয় দেশে পুষ্টি সুবিধা থেকে শুরু করে টিকাদান কার্যক্রমসহ বিভিন্ন সেবা স্থগিত থাকার কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখ ২৮ হাজার বেড়েছে।
নেপাল ও বাংলাদেশে মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা ৮০ শতাংশ শিশু পুষ্টি কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ভারতে টিকাগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা ৩৫ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৬৫ শতাংশ কমে গেছে।
২০২০ সালে ভারতে শিশু মৃত্যু সবচেয়ে বেশি ছিল। দেশটিতে গত বছর শিশু মৃত্যুর হার ১৫.৪ শতাংশ বেড়েছে। আর বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু বেড়েছে ১৩ শতাংশ। মাতৃমৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। ২০২০ সালে দেশটিতে মাতৃমৃত্যুহার বেড়েছে ২১.৫ শতাশ। এর পরপরই রয়েছে পাকিস্তানের অবস্থান। দেশটিতে মাতৃমৃত্যু বেড়েছে ২১.৩ শতাংশ।
প্রতিবেদনে গর্ভবতী নারী, কিশোর-কিশোরী এবং শিশুদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। টিকা সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা জোরদার এবং শিশুদের প্রয়োজনীয় ওষুধের যোগান নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ইউনিসেফ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া আদজেয় বলেন, সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় দরিদ্র পরিবারগুলোতে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। দরিদ্র মা ও শিশুর জন্য এই সেবাগুলো অপরিহার্য।
ইউএনএফপিএর এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক বোজঁর অ্যান্ডারসন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পরিষেবাগুলো বন্ধ হওয়ায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একইসঙ্গে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং তথ্য পরিষেবাদির অবনতির কারণে ৩.৫ মিলিয়ন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের সম্ভাবনা রয়েছে।
যদিও ডাব্লিউএইচও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. পুনম ক্ষেত্রপাল সিং বলেন, এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোর ধারাবাহিকতা এবং পুনরায় শুরু করার কার্যক্রম শুরু করেছে।
বাংলাদেশে মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে শিশুরা
করোনা মহামারির এই সময়ে শিশুরা অন্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে বেশি৷ কারণ তিন মাস শিশুদের ১০টি রোগের ছয়টি জীবন রক্ষাকারী টিকা দেয়া এক প্রকার বন্ধ ছিল লকডাউনের কারণে৷ অনেক টিকাদান কেন্দ্রই বন্ধ ছিল৷ আবার যখন শুরু হয় তখন অনেক শিশুর অভিভাবক করোনার কারণে তাদের শিশুদের টিকাদান কেন্দ্রে নেননি৷
এছাড়া শিশুরা বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা এখন সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার হচ্ছে৷ ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বলে জানান শিশু চিকিৎসক ডা. সাঈদা আনোয়ার ৷
শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি বাধাগ্রস্থ হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব অনেক ভয়াবহ হতে পারে৷ আর এটা বোঝা যাবে আরো কয়েক মাস পর৷ চিকিৎসরাও কেউ কেউ করোনার শুরুতে টিকাদানকে নিরুৎসাহিত করেছেন৷ কারণ কোনো কোনো টিকা দিলে জ্বর আসে৷
তবে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) পরিচালক ডা. শামসুল হক জানান, ‘‘করোনার কারণে শিশুদের বড় একটি অংশ টিকা না নিলেও এখন তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ প্রতি মাসেই টিকা দেয়া হয়৷ মার্চ এপ্রিলে কিছু সমস্যা ছিলো৷ এখন সবাই তাদের সন্তানদের নিয়ে টিকাদান কেন্দ্রে আসছেন৷’’
ঝুঁকি হ্রাসে করণীয়
যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও মাইলাইটিস, হাম ও রুবেলা- শিশুদের এই ১০টি রোগের জন্য ছয়টি টিকা দেয়া হয়৷
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ মুয়াজ মনে করেন, ‘‘করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেকোনো উপায়ে শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে৷ নয়তো এই রোগে তারা আক্রান্ত হতে পারে৷’’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিচ্ছে বলে জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ৷ তিনি দাবি করেন, ‘‘টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ নেই৷ করোনার শুরুতেও বন্ধ ছিলো না৷ বন্ধ হবেও না৷’’
করোনার কারণে সবকিছু থমকে গিয়েছিলো৷ এখন নারী শিশু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার জন্য আলাদা কমিটি হচ্ছে৷ তবে তিনি মনে করেন, ‘‘সব হাসপাতালে শিশুদের জন্য আলাদা করোনা ইউনিটের প্রয়োজন নাই৷ নারী, শিশু সবাইকে করোনা রোগী হিসেবেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷’’
এই করোনাকালে খাদ্য ও পুষ্টির বিষয়টি সরকার দেখছে৷ তবে সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়৷ অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে৷ অনেকের আয় কমে গেছে৷ তাই সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক৷
বিশ্বজুড়ে গর্ভবতী মায়েদের পক্ষে ইউনিসেফ করোনা মহামারির সময়ে জীবন রক্ষায় বিভিন্ন দেশের সরকার ও স্বাস্থ্য সেবাদাতাদের প্রতি নিম্নোক্ত জরুরি আহ্বান জানিয়েছে-
- ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় সব ধরনের পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অনুসরণ, কোভিড-১৯ এর উপসর্গ দেখা দিয়েছে কি না তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং কারও উপসর্গ দেখা দিলে বা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে নিকটস্থ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের পরামর্শ নিতে হবে।
- অন্যদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ এড়াতেও একই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে; শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, একসঙ্গে হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অনলাইনে স্বাস্থ্য সেবা পরামর্শ নিতে হবে।
- আক্রান্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস, কাশি বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা সেবা নিতে হবে।
- মায়ের দুধের নমুনা পরীক্ষায় ভাইরাস পাওয়া না যাওয়ায় মা সংক্রমিত বা সংক্রমণ ঘটেছে বলে সন্দেহ হলেও শিশুকে বুকের দুধ খাইয়ে যেতে হবে। আক্রান্ত মায়েদের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মুখে মাস্ক পরতে হবে, শিশুকে স্পর্শ করার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে এবং তিনি যেসব জায়গা ও জিনিসপত্র ব্যবহার করবেন সেগুলো নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
- মা নবজাতককে ধরতে পারবেন এবং বুকের মধ্যে নিয়ে রাখতে পারবেন (স্কিন টু স্কিন কেয়ার)।
- নিরাপদে সন্তান জন্মদান কোথায় হবে সে বিষয়ে ধাত্রী বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং উদ্বেগ কমাতে সন্তান জন্মদান নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে হবে এবং প্রয়োজনের সময় ওই জায়গা যেন পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
- শিশুর জন্মের পরেও নিয়মিত টিকাদানসহ চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
কোভিড-১৯ মহামারির আগেও প্রতি বছর ২৮ লাখ অন্তঃসত্ত্বা নারী ও নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে, অর্থাৎ প্রতি ১১ সেকেন্ডে একজন। প্রতিরোধ করা যায় এমন কারণেই অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়। গর্ভের সময়, সন্তান জন্মদান ও জন্মের পরে জটিলতা প্রতিরোধ ও তার চিকিৎসায় প্রতিটি মা ও নবজাতক যেন নিরাপদ হাতের সেবা পায় সেজন্য স্বাস্থ্য কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে প্রস্তুত রাখতে হবে ভয়াবহ এই বিপর্যয় এড়াতে হলে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২৫
আপনার মতামত জানানঃ