
নন্দীগ্রামের রানিচকে একটি মন্দিরে হরিনাম সংকীর্তনে অংশ নিয়ে বেরনোর সময় পড়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বাঁ পায়ের সঙ্গে মাথা এবং কপালেও চোট লেগেছে। তাকে নন্দীগ্রাম থেকে ‘গ্রিন করিডর’ করে কলকাতায় নিয়ে আসা হচ্ছে সড়কপথে।
ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ভিড়ের মধ্যে তাকে চার-পাঁচ জন ধাক্কা দেয়। ঘটনার সময় কোনও পুলিশকর্মী বা জেলার পুলিশ সুপার কেউই ছিলেন না।
গোটা ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। বিজেপি এবং কংগ্রেস যদিও মমতার এই পড়ে যাওয়াকে ‘নাটক’ বলে মন্তব্য করেছে।
এদিকে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘মমতা মানুষের সঙ্গে মেশেন। সেই সুযোগ নিয়ে তাকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় পুলিশের অধীনে যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তা নেওয়া হয়নি। পুলিশ এখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে। মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূলনেত্রীর ক্ষেত্রে যদি এমন হয় তা হলে বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং ইঙ্গিতবাহী। যারা নন্দীগ্রামে মমতার উপস্থিতি চান না এবং যারা মমতার উপস্থিতিতে ভীত তারাই এমন কাজ করবেন। চক্রান্ত করে না হলে এমন ঘটনা ঘটত না।’’
ঠিক কী ঘটেছিল নন্দীগ্রামে?
এদিন সকালে মনোনয়নপত্র দাখিল করার পর নন্দীগ্রামে একাধিক মন্দির দর্শনের কর্মসূচি ছিল মমতার। এদিন বিকেলে নন্দীগ্রাম এলাকায় মোট ৮টি মন্দির দর্শন করেন তিনি। মন্দির দর্শনের পর নন্দীগ্রামের রানিচকে একটি হরিনাম সংকীর্তনের অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ করতে দেখা যায় মমতাকে। সেখান থেকে তিনি রওনা দেন বিরুলিয়ার উদ্দেশে। রাস্তায় রীতিমতো অসুস্থ বোধ করতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে।
মমতার দাবি, তাকে পিছন থেকে চার-পাঁচজন ধাক্কা মারে। ভিড়ের মধ্যে ৪-৫ জন বাইরে থেকে ঢুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় তাকে। ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা মারা হয়ছে বলে জানান তিনি। এর পিছনে ষড়যন্ত্র ছিল বলে অভিযোগ করেন।
পড়ে গিয়ে পা ফুলে গিয়েছে বলেও জানান মমতা। তিনি বলেন, ‘‘দেখো কিতনা ফুল গয়া।’’
পড়ে যাওয়ার পর মমতা আর হাঁটতে পারছিলেন না। তাঁলকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তোলা হয়। একটি দোকান থেকে বরফ নিয়ে দেওয়া হয় তার বাঁ পায়ে। জড়িয়ে দেওয়া হয় কাপড়।
মমতার দাবি, তার বাঁ পা ফুলে গিয়েছে। কপাল ও মাথায় চোট লেগেছে। জ্বর জ্বর ভাবও রয়েছে। এমনকি তার বুকে ব্যথা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন মমতা।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী নিজের কর্মসূচি বাতিল করে আজই কলকাতায় ফিরছেন। তাকে গ্রিন-করিডোর করে শহরে আনা হচ্ছে। এসএসকেএমের অর্থপেডিক বিশেষজ্ঞরা তাকে দেখবেন।
সাজানো নাটক বলে বিরোধীদের মন্তব্য
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর মতো ভিভিআইপির নিরাপত্তায় এত বড় গলদ হল কীভাবে? মুখ্যমন্ত্রী এমনিতে জেড ক্যাটেগরির নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন। তাকে তার নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা ঘিরে থাকেন। সেই সঙ্গে স্থানীয় পুলিশেরও থাকার কথা।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, এদিন তার কর্মসূচি চলাকালীন স্থানীয় কোনও পুলিশ ছিল না। এবং তাকে চক্রান্ত করে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন তুলতে হয়। কারণ, এই মুহূর্তে রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরোপুরি কমিশনের উপর।
এদিকে, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-র কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেন, ‘‘উনার সঙ্গে সাদা পোশাকে বহু পুলিশ থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর মতো নিরাপত্তা নিয়ে বেরোন। পদযাত্রার সময় ১০০ পুলিশ থাকে। স্কুটি চালানোর সময়ও তো কত পুলিশ ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আজ নিরাপত্তা ছিল না, এটা কি মানা যায়? আঘাত পেয়েছেন। অবশ্যই সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু ভোটের আগে এ নিয়ে তিনি রাজনীতি করছেন, মানুষের সহানুভূতি আদায় করছেন। সিবিআই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’’
প্রাদেশিক কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘পুলিশমন্ত্রী বলছেন, পুলিশ ছিল না। পুলিশ না থাকা অবস্থায় হামলা হল! এটা অসম্ভব। এটা নির্বাচনী গিমিক। একটা সমবেদনা তৈরি করা। আর বাংলার পুলিশমন্ত্রী যদি পুলিশ না পান, তা হলে বাংলার সাধারণ মানুষের কী হবে? তাহলে মমতা স্বীকার করুন যে, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে ভেঙে পড়েছে।’’
সিবিআই তদন্তের দাবি বিজেপির
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরাপত্তা নিয়ে সিবিআই তদন্ত দাবি জানাল বিজেপি। দলের শীর্ষনেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় ওই দাবি তুলেছেন। পাশাপাশি, ‘উচ্চপর্যায়ের তদন্ত’ও দাবি করেছে বিজেপি।
বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেন, ‘‘এটা একেবারেই সহানুভূতি কুড়ানোর প্রয়াস। যদি উনি চক্রান্তের অভিযোগ করেন, তা হলে দ্রুত এই ঘটনার তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে দেওয়া হোক। উনি এ ভাবে বিরোধীদের বদনাম করার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশিই, নিজের দিকে সহানুভূতি টানতে চাইছেন। উনি যখন রাস্তায় মিছিলে হাঁটেন, তখন তার ২০০ গজের মধ্যে কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। মনে হয়, যেন প্রধানমন্ত্রীর মিছিল যাচ্ছে! উনার ধারেপাশে যদি কেউ গিয়ে থাকেন, তা হলে তো সেটা উনারই পুলিশের গাফিলতি! সিবিআই-কে দিয়ে তদন্ত করালেই সত্য প্রকাশিত হবে। সেটা উনি করাচ্ছেন না কেন।’’
দলের অন্যতম মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘এই ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি হোক। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার নিরাপত্তায় কোনও ফাঁক থাকলে তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখা উচিত।’’
শমীকের আরও বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর আশেপাশে তখন কেন কোনও পদস্থ পুলিশ অফিসার ছিলেন না বা পুলিশকর্মী ছিলেন না, তা জানার জন্যই তদন্ত দরকার।’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার কঠিন লড়াইয়ের মুখে মমতা। তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বিজেপি। ফলে পশ্চিমবঙ্গের এবারের ভোট খুবই চিত্তাকর্ষক হবে। মমতার সামনেও লড়াই রীতিমতো কঠিন। এবার মুখ্যমন্ত্রী নিজে লড়ছেন নতুন কেন্দ্র নন্দীগ্রামে। তার আগের কেন্দ্র ভবানীপুরে নয়। বিজেপি-তে যোগ দেয়া তার একদা লেফটন্যান্ট শুভেন্দু অধিকারীর চ্যালেঞ্জ ভোঁতা করে দিতে তিনি এই সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১০ মার্চ তিনি মনোনয়নপত্র পেশ করবেন। নন্দীগ্রামে ইতিমধ্যে বড়সড় জনসভা করেছেন মমতা।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৪৪
আপনার মতামত জানানঃ