দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা দুর্নীতির মামলায় ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের সাজা কমেছে। বিচারিক আদালতের দেয়া ১৩ বছরের কারাদণ্ড কমিয়ে ১০ বছর বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এদিকে দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ায় হাজী সেলিমকে সংসদ সদস্য পদ ছাড়তে হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী তার আর সংসদ সদস্য পদ থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। অপরদিকে রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে হাজী সেলিমকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আজ মঙ্গলবার (৯ মার্চ) বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। অপরদিকে হাজী সেলিমের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তামান্না ফেরদৌস।
হাইকোর্টের রায়ে, দুদক আইনের মামলায় (২৬ এর ২ ধারা) সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালত যে ৩ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন, সেই অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় হাজী সেলিমকে তথ্য গোপনের অভিযোগ থেকে খালাস দেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, দুদক এই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।
কিন্তু দুদক আইনের ২৭ (১) ধারা অনুসারে হাজী সেলিমকে জ্ঞাত আয় বহির্ভুতভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিচারিক আদালত ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। ওই অভিযোগে তার সাজা বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশের রায় দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি বিচারিক আদালত যেদিন হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাবে সেদিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে হাজী সেলিমকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। আর আত্মসমর্পণ না করলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে বলা হয়েছে। আর যেসব সম্পত্তি নিয়ে এই সাজা প্রদান করা হয়েছে তা বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় অনুকূলে চলে যাবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, এই মামলায় বিচারিক আদালতে ২০ জন সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। সেইসব সাক্ষ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে, দুদক আইনের ২৭ (১) ধারা অনুসারে বিচারিক আদালত কর্তৃক হাজী সেলিমকে ১০ বছরের সাজাপ্রদান যথাযথ ও আইনসঙ্গত হয়েছে। তবে এই মামলার অপর আসামি হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা মারা যাওয়ায় তার আপিল আবেদন বাতিল করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এর আগে গেল ২৪ ফেব্রুয়ারি হাজী সেলিমের ১৩ বছরের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শেষে রায়ের জন্য ৯ মার্চ দিন ধার্য করা হয়। সেদিন আদালতে হাজী সেলিমের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার, আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। অপরদিকে আইনজীবী খুরশিদ আলম খান দুদকের পক্ষে ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান মনির রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন।
গত ৩১ জানুয়ারি হাজী সেলিমের ১৩ বছরের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শুরু হয়।
গত বছরের ১১ নবেম্বর হাজী সেলিমের ১৩ বছরের দণ্ডের মামলার বিচারিক আদালতে থাকা যাবতীয় নথি (এলসিআর) তলব করেন হাইকোর্ট। ওই বছরের ৯ নভেম্বর হাজী সেলিমের মামলাটি হাইকোর্টে দ্রুত শুনানির জন্য কার্যতালিকাভুক্ত করতে উপস্থাপন করা হয়।
অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালে হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মামলা করে দুদক। এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল বিচারিক আদালতের রায়ে হাজি সেলিমের ১৩ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা হয়। এর বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন।
২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট হাজি সেলিমের সাজা বাতিল করে রায় দেন। খালাস পান হাজি সেলিম। তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল বিভাগে আবেদন করে। দুদকের করা আপিলের শুনানি নিয়ে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেন। একই সঙ্গে হাইকোর্টে ওই আপিল (হাজি সেলিমের) পুনঃ শুনানি করতে বলা হয়। এরপর প্রায় পাঁচ বছর ওই আপিলের আর পুনঃ শুনানি হয়নি। এ মামলায় হাজি সেলিম জামিনে আছেন।
এদিকে দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ায় সংসদ সদস্য (এমপি) পদ হারাচ্ছেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। সংবিধান অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
তিনি জানিয়েছেন, সাজা বহালের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সেটি দুদকের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। এরপর স্পিকার হাজী মোহাম্মদ সেলিমের সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো আইনপ্রণেতা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই কিংবা ততধিক বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবে না এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন না।
তবে হাজী সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা অনলাইন ভিত্তিক এক সংবাধ মাধ্যমকে বলেছেন, তারা হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
তিনি বলেন, “সম্পদের উৎসের বিষয়ে বিচারিক আদালতের রায়ে যে সাজা দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু উৎস থেকে যে সম্পদ অর্জিত হয়েছিল, সে সম্পদের কারণে তার সাজা বহাল রাখা হল। মূলত এই গ্রাউন্ডেই এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।”
এ আইনজীবী বলেন, এ মামলাটি একেবারে ব্যতিক্রম একটি মামলা। ২০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য একদিনে নেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের ২২ মে এ মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর ২৭ মে রায় হয়। অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার ৫ দিনের মধ্যে একটি মামলার বিচারকাজ কীভাবে শেষ হয়! এই বিষয়গুলো উচ্চ আদালত বিবেচনায় নেননি। ফলে আমরা আপিল করব।”
এর আগে চলতি মাসের শুরুতে হাজী সেলিমের ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ড (বরখাস্ত) কাউন্সিলর ইরফান সেলিমকে মাদক মামলা থেকেও অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। গত ১মার্চ ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান এ রায় দেন। পুলিশ ইরফানের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় আদালত এ মামলায় আর তদন্ত করার আদেশ দেননি।
তারও আগে অস্ত্র মামলা থেকেও তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ধারাবাহিকতায় উভয় মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন ইরফান সেলিম। আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের শাস্তি এখনো বহাল থাকলেও তাতে তিনি জামিন পেয়েছেন৷ বাকি আছে শুধু নৌবাহিনীর কর্তকর্তাকে মারধর ও হত্যা চেষ্টা মামলায় জামিন৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, এদেশে প্রভাভশালীদের মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে পূর্ব থেকে ধারণা করার অধিকাংশই সত্যে পরিণত হয়। কেননা এদেশে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালীদের শাস্তি দেওয়ার তেমন একটা রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। অন্যায় অপরাধ করেও তারা যেকোনোভাবে পার পেয়ে যেতে পারেন।
তারা বলেন, অনেক বড় রাঘব বোয়ালরা দুর্নীতিতে জড়িত। আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক যে কাঠামো রয়েছে তাতে দুর্নীতির রাঘব বোয়ালদের ধরা সম্ভব নয়। কারণ তাদের ওপর কাঠামো নির্ভর করে। এটা দুর্নীতি দমন কমিশনও বলেছে। যখন রাজনৈতিকভাবে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়, জনগণ চাপ সৃষ্টি করে তখন কাউকে হয়তো ধরা হয়।
তারা বলেন, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী হওয়াতে ইরফান সেলিমের মতো পিতা হাজী সেলিমও হয়তো আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়বেন। ক্ষমতা আছে বলেই এতো বছরের সাজা কাঁধে নিয়ে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। অথচ আইন অন্যদের ক্ষেত্রে একদমই ভিন্ন চিত্র দেখায়। তারা মনে করেন, আমাদের রাষ্ট্রে বিচারের এই বৈষম্য দূর না হলে দেশ থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অন্যায়-অপকর্ম হ্রাস পাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৬
আপনার মতামত জানানঃ