ঢাকা-৭ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া ১৩ বছরের কারাদণ্ড কমিয়ে ১০ বছর বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। তবে তথ্য গোপনের অভিযোগে বিচারিক আদালতে তার যে তিন বছরের সাজা হয়েছিল— তা বাতিল করা হয়েছে।
হাইকোর্টে বহাল থাকা ওই রায় আজ (৯ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশ করা হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণ হাইকোর্ট বলেছে, রায়ের আগে বিচারপতিদের অনৈতিক প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।
গতবছর ৯ মার্চ জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে রায় পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। আত্মসমর্পণ না করলে জামিন বাতিল করে হাজী মোহাম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পূর্ণাঙ্গ রায়েও এ কথা উল্লেখ রয়েছে।
এদিকে হাইকোর্টের এ রায় কার্যকর হলে সংবিধান অনুযায়ী হাজী সেলিমের এমপি পদ থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের অ্যাডভোকেট মো: খুরশীদ আলম খান।
কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো আইন প্রণেতা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই কিংবা ততোধিক বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এমপি পদে থাকার যোগ্য হবেন না এবং মুক্তি পাওয়ার পর ৫ বছর পর্যন্ত তিনি আর এমপি হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন না। খুরশীদ আলম খান বলেন, আমি মনে করি এটি তার (হাজী সেলিম) নৈতিক স্খলন। তিনি সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
হাইকোর্টের এ রায় কার্যকর হলে সংবিধান অনুযায়ী হাজী সেলিমের এমপি পদ থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের অ্যাডভোকেট মো: খুরশীদ আলম খান।
গতবছর ৯ মার্চ রায় ঘোষণার পর খুরশীদ আলম খান বলেছিলেন, দুদক আইনে (২৬ এর ২ ধারা) করা মামলায় সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালত ৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। সেই অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে তথ্য গোপনের অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, দুদক এ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু দুদক আইনের ২৭ (১) ধারা অনুসারে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালত ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। ওই অভিযোগে তার সাজা বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে হাজী সেলিমকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে যেসব সম্পত্তি নিয়ে এ সাজা দেয়া হয়েছে তা বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিতে হবে।
২০২০ সালের ১১ নভেম্বর এ মামলার বিচারিক আদালতে থাকা যাবতীয় নথি (এলসিআর) তলব করেছিলেন উচ্চ আদালত। সে আদেশ অনুসারে নথি আসার পর আপিল শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়।
আদালত তার রায়ে বলেন, বিচারিক আদালতের রায়ে দণ্ডিত হাজী মোহাম্মদ সেলিমের আপিল সংশোধন করে (আংশিক গ্রহণ ও আংশিক খারিজ) দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬ ধারা সংক্রান্ত আপিল গ্রহণ করা হলো। এই আইনের ২৭ (১) এ আপিলের অংশ খারিজ করা হলো।
এর আগে হাজী সেলিমের করা আপিলের ওপর গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য ৯ মার্চ দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট। ধার্য দিনে সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের করা আপিলের ওপর এ রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট ভার্চুয়াল বেঞ্চ।
হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালে তার বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মামলা করেছিল দুদক। এই মামলায় ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল বিচারিক আদালত রায়ে হাজি সেলিমকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এর বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট হাজী সেলিমের সাজা বাতিল করেন। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করে।
দুদকের করা আপিলের শুনানি নিয়ে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেন। একইসঙ্গে ওই আপিল (হাজি সেলিমের) হাইকোর্টে পুনঃ শুনানি করতে বলা হয়। এরপর প্রায় পাঁচ বছর ওই আপিলের আর পুনঃশুনানি হয়নি। এ মামলায় হাজী সেলিম জামিনে আছেন।
এরপর আপিলটি শুনানির উদ্যোগ নেয় দুদক। বিষয়টি হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতে থাকা নথি তলব করেন। পরে কয়েক দফা শুনানি শেষে রায়ের জন্য রাখেন আদালত।
এর আগে গত বছরের মার্চ মাসের শুরুতে হাজী সেলিমের ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ড (বরখাস্ত) কাউন্সিলর ইরফান সেলিমকে মাদক মামলা থেকেও অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। গত ১মার্চ ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান এ রায় দেন। পুলিশ ইরফানের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় আদালত এ মামলায় আর তদন্ত করার আদেশ দেননি।
তারও আগে অস্ত্র মামলা থেকেও তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ধারাবাহিকতায় উভয় মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন ইরফান সেলিম। আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের শাস্তি এখনো বহাল থাকলেও তাতে তিনি জামিন পেয়েছেন৷ বাকি আছে শুধু নৌবাহিনীর কর্তকর্তাকে মারধর ও হত্যা চেষ্টা মামলায় জামিন৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, এদেশে প্রভাভশালীদের মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে পূর্ব থেকে ধারণা করার অধিকাংশই সত্যে পরিণত হয়। কেননা এদেশে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালীদের শাস্তি দেওয়ার তেমন একটা রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। অন্যায় অপরাধ করেও তারা যেকোনোভাবে পার পেয়ে যেতে পারেন।
তারা বলেন, অনেক বড় রাঘব বোয়ালরা দুর্নীতিতে জড়িত। আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক যে কাঠামো রয়েছে তাতে দুর্নীতির রাঘব বোয়ালদের ধরা সম্ভব নয়। কারণ তাদের ওপর কাঠামো নির্ভর করে। এটা দুর্নীতি দমন কমিশনও বলেছে। যখন রাজনৈতিকভাবে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়, জনগণ চাপ সৃষ্টি করে তখন কাউকে হয়তো ধরা হয়।
তারা বলেন, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী হওয়াতে ইরফান সেলিমের মতো পিতা হাজী সেলিমও হয়তো আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়বেন। ক্ষমতা আছে বলেই এতো বছরের সাজা কাঁধে নিয়ে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। অথচ আইন অন্যদের ক্ষেত্রে একদমই ভিন্ন চিত্র দেখায়। তারা মনে করেন, আমাদের রাষ্ট্রে বিচারের এই বৈষম্য দূর না হলে দেশ থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অন্যায়-অপকর্ম হ্রাস পাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৮
আপনার মতামত জানানঃ