বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশ তুলনামূলক দুর্বল, সেসব দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দীর্ঘ এতগুলো বছর ধরে বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবেই ছিল। অবশেষে গত ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) বৈঠকে বাংলাদেশকে এলডিসি উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়েছে।
সাধারণত সিডিপির চূড়ান্ত সুপারিশের ৩ বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ বিবেচনায় ২০২৪ সালে এই তালিকা থেকে বাংলাদেশের বের হওয়ার কথা থাকলেও করোনার প্রভাব মোকাবিলায় আরও ২ বছর বেশি সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ, ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ আর এলডিসি তালিকায় থাকছে না।
এলডিসি থেকে কোন কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি)। এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। নিয়ম অনুসারে উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে তিন বছর গড় মাথাপিছু আয় লাগবে ১ হাজার ২৩০ ডলার; কিন্তু বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ১ হাজার ৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ উন্নয়নে সূচকের মানদণ্ড ৬৬। বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫ দশমিক ৪। আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক ৩২ এর নিচে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭। অর্থাৎ তিন সূচকেই মানদণ্ড পরিপূর্ণ করেছে বাংলাদেশ। কাজেই সবকিছু ঠিক থাকলে ৫ বছর পর এলডিসি থেকে বের হয়ে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যাবে বাংলাদেশ।
এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। কিছু সুবিধাও মিলবে অবশ্য। এলডিসি থেকে বের হলে প্রথমে যে সুবিধাটি পাবে তা হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশের তকমা থাকবে না। পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হবে। অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক বেশি ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে। বেশি ঋণ নিতে পারলে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে আরও বেশি খরচ করতে পারবে বাংলাদেশ। আবার অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা মোকাবিলায় যথেষ্ট সক্ষমতা থাকায় বিদেশি বিনিয়োগও আকৃষ্ট হবে। অবশ্য বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ পরিবেশ বড় ভূমিকা পালন করে।
এলডিসি উত্তরণের পর সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে রপ্তানি খাত। কারণ, গরিব দেশ হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও এই ধরনের শুল্ক সুবিধা পেয়ে থাকে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। সম্প্রতি প্রকাশিত ডব্লিউটিওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বাড়তি শুল্কের কারণে রপ্তানি বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে।
বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে ওষুধশিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব(পেটেন্ট) বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসাবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে হয় না। নতুন করে মেধাস্বত্বের ওপর অর্থ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে ওষুধের ৯৭ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু এলডিসির কারণে এসব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। এসব সুবিধা প্রত্যাহার হয়ে যাবে। এতে ওষুধের দাম বাড়বে।
একই সমস্যায় পড়বে আইটি খাত। কারণ, বর্তমানে এখানেও মেধাস্বত্বের ওপর অর্থ দিতে হয় না। এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি বলে ধরে নেওয়া হয়। তখন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশও এ ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে। এছাড়া এলডিসি হিসাবে যে কোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন কৃষি ও শিল্প খাতের নানা পণ্য বা সেবায় ভর্তুকি দেয়। এসব ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার চাপ আসবে। এমনকি বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে।
এলডিসি থেকে বের হলে জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশকে আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। এছাড়া স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সরকারি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতে সৌজন্য টিকিট পান। গরিব দেশের কর্মকর্তা হিসাবে এই টিকিট দেওয়া হয়। ২০২৬ সালের পর এ ধরনের বিনা পয়সার টিকিট মিলবে না। আবার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এ ধরনের বৃত্তির সংখ্যা কমবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য বড় একটি স্বীকৃতি। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। তবে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে পারে। বিশেষ করে বাণিজ্য সুবিধা কমবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বে। আর এ অবস্থার উত্তরণে বেশকিছু কাজ করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবহিদিতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ২০২৬ সাল খুব বেশি দূরে নয়। ফলে আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে রপ্তানি খাত। শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণেই বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে পোশাকশিল্প আজ এই সুদৃঢ় অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। পোশাক খাতেই বড় ধাক্কা আসবে। তিনি আরও বলেন, এলডিসি থেকে বের হলে অসুবিধাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আরোপিত হবে। কিন্তু সুবিধাগুলো অর্জন করতে হবে। কারণ, বিনিয়োগ আকর্ষণে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। অবকাঠামো ও মানবসম্পদ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৩৫
আপনার মতামত জানানঃ