একটা সময় ছিল যখন নারীদের শিক্ষা দীক্ষায় আগ্রহ দেখাতেন না অভিভাবকেরা। সেই কুসংস্কার ক্রমশ ম্লান হয়ে এখন দেশের অধিকাংশ নারীরাই শিক্ষার আওতায় চলে আসছেন। তবে নারীদের শিক্ষায় দীক্ষায় অভিভাবকেরা যে এখনো পরিপূর্ন সচেতন এ দাবি জোর দিয়ে করা যাচ্ছে না। অনেক নারীই এখনো শিক্ষার বাইরে থাকেন। সমাজ এবং ধর্মের যাঁতাকলে পড়ে নারীরা শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে থাকলেও নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার বিষয়টি সবার আগে সামনে আসে। কেননা দেশে এখনো নারীরা নিরাপদ নয়। এখনো স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণের বিষয়ে নারীদের রয়েছে বিস্তর প্রতিবন্ধকতা। এসব উপেক্ষা করেও যেসব অভিভাবক কন্যাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান তাদের মনে দেখা দিয়েছে নতুন এক আতঙ্ক। রাস্তার বখাটেদের মতো এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করে থাকেন। তেমনি এক ঘটনা জানা গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার সলিমগঞ্জ এ আর এম উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা বিভাগের শিক্ষক মো. আল-আমিনের বিরুদ্ধে প্রাইভেট পড়ানোর সময় এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। যৌন হয়রানির ওই ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনায় ওই শিক্ষকের শাস্তি চেয়ে প্রধান শিক্ষক বরাবর আবেদন করেছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ঘটনার সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
জানা যায়, অভিযুক্ত শিক্ষক আল-আমিন ২০১৩ সালে সলিমগঞ্জ এ আর এম উচ্চ বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। তখন থেকে বিভিন্ন বাড়িতে বাসাভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন। সম্প্রতি হাইস্কুল সংলগ্ন নাজিম উদ্দিনের বাড়িতে দুটি রুম ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে যথারীতি প্রাইভেট পড়ার সময় টেবিলের নিচ দিয়ে এক ছাত্রীর উরুতে স্পর্শ করেন। ওই ছাত্রী বার বার হাত সরিয়ে দিলেও তিনি একই কাজ করতে থাকেন। সেই সময় এক শিক্ষার্থী বিষয়টি টের পেয়ে গোপনে টেবিলের নিচ দিয়ে দৃশ্যটি ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। ঘটনার পরদিন সকালে অভিযোগ দেয় শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, শিক্ষক আল-আমিন প্রাইভেট পড়ানোর সময় তার পাশে কোনো ছাত্রকে বসতে দিতেন না। বরাবরই ছাত্রীদের তার পাশে বসিয়ে পড়াতেন।
তার বিরুদ্ধে অন্য ছাত্রীদের সঙ্গেও যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক আল-আমীন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আসলে ভাই কি বলব, বলার ভাষা নেই। আমি মরে গেছি। ঘটনার সত্য-মিথ্যা কিছুই বলব না। কমিটির কাছ থেকে আমি এক মাসের সময় নিয়েছি বোঝাপড়ার জন্য।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলের বিক্ষুব্ধ কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং ওই শিক্ষকের নিজ ইচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার আবেদন অনুমোদন করেছে। এ ঘটনা তাদের ব্যথিত করেছে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক আহম্মদ আলী ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা স্বীকার করে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে সভা করেছি। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির ওই সভায় অভিযুক্ত শিক্ষক স্কুল থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন মর্মে কমিটির সভাপতি বরাবর একটি লিখিত আবেদন দিয়ে এক মাসের সময় চেয়েছেন।’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোকাররম হোসেন বলেন, বিষয়টি খুবই ন্যক্কারজনক ও নিন্দনীয়। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি তাকে অব্যাহতি দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শুনেছি।
এদিকে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও পচাসারুটিয়া মেহের আলী খান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফরহাদ আলীকে (৪৫) যৌন হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় স্কুল পরিচালনা কমিটির সভায় আজ মঙ্গলবার( ০২ মার্চ) এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এবিষয়ে স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা ডা. তাহেরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি পবিত্র স্থান। এখানে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করে। জেনে শুনে একজন অপরাধীকে বহাল রাখতে পারি না। প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে এবং শিক্ষার্থীদের ফের স্কুলমুখী করতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, উপজেলার এক হতদরিদ্র কাঠমিস্ত্রির স্ত্রীকে চাকরি দেয়ার কথা বলে সম্পর্ক গড়ে তোলেন পচাসারুটিয়া মেহের আলী খান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফরহাদ আলী। তাকে মোবাইল ফোনে ও সরাসরি একাধিকবার শারীরিক সম্পর্কের জন্য প্রস্তাব দেন। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই নারীর সঙ্গে শিক্ষক ফরহাদ আলীর আপত্তিকর কথোপকথনের একাধিক অডিও ভাইরাল হয়।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নাগরপুর আমলি আদালতে প্রধান শিক্ষকসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত চার-পাঁচজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
বিষয়টি জানাজানি হলে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্কুল পরিচালনা কমিটি। পরে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষকদের কেবল চাকরি থেকে বরখাস্ত নয়, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শিক্ষকদের যৌন লালসার শিকার হয়ে ছাত্রীরা এখন বিদ্যালয়ে পা মাড়াতে ভয় পায়। শিক্ষকদের সাথে ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক সম্পর্ক ব্যবহত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে যেসব অগ্রগতি সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের এমন যৌন লালসার কারণে একদিকে যেমন শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে নারীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহে ভাটা পড়ছে বলে মনে করেন তারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠানে সবধরনের যৌন হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/জেএন/কেএইচ/২০৩৪২
আপনার মতামত জানানঃ