শিক্ষকরা হচ্ছেন জাতির সবেচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তি। শিক্ষকদের হাতেই গড়ে ওঠেন প্রজন্মের মেধাবী ও প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বরা। তাই পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসের সূচনা থেকেই শিক্ষকতা পেশা সবার কাছে সমানহারে সম্মানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরম সম্মানীয় এই শিক্ষক মহোদয়দের কেউ কেউ লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। হচ্ছেন অপমানিত। একসময় যে শিক্ষাগুরুরা মান্যবর ছিলেন এলাকার মাতব্বর থেকে নিয়ে প্রতিটা মানুষের কাছে, সে শিক্ষকদেরকেই আজ স্থানীয় ক্ষমতাসীন ক্যাডার বা নেতাদের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। চলতে হয় তাদের মর্জিমাফিক। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বাধ্য করা হয় তাদেরকে।
এরই ধারাবাহিকতায় মাদারীপুরে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সামনে এক শিক্ষককে মারধরের ঘটনায় আওয়ামী লীগের উপজেলা কমিটির এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ শিক্ষার্থীদের পুরি-সিঙ্গারা খেতে নিষেধ করায় দোকানদারের ভাই শিক্ষকের ওপর ক্ষিপ্ত হন এবং মারধর করেন৷
মঙ্গলবার রাতে উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের বাড়ি থেকে ৬০ বছর বয়সি দেলোয়ার খাঁ নামের ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি মনোয়ার হোসেন চৌধুরী৷
এর আগে সন্ধ্যায় উপজেলার ৪৩ নং সাবেক কালিকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কাজী এনামুল হক সদর থানায় দেলোয়ার খাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন৷
মামলার নথির বরাতে ওসি মনোয়ার জানান, দেলোয়ার খাঁর মামাতো ভাই আক্তার খাঁ একই বিদ্যালয়ের সামনে একটি পুরি-সিঙ্গারার দোকান চালান৷ এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের শারীরিক সুস্থতার কথা চিন্তা করে নিয়মিত পুরি-সিঙ্গারা খেতে নিষেধ করেন শিক্ষক এনামুল হক৷
এতে দেলোয়ার খাঁ ক্ষিপ্ত হয়ে মঙ্গলবার দুপুরে ক্লাস চলাকালে স্কুলে ঢুকে শিক্ষার্থীদের সামনে শিক্ষক এনামুল হককে এলোপাথারি কিল-ঘুষি ও চর-থাপ্পর মারেন৷ পরে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন৷
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষক এনামুল হক সন্ধ্যায় সদর মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ৷ পুলিশ অভিযোগ আমলে নিয়ে নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করে আলমগীর খাঁকে গ্রেপ্তার করে৷
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের সভাপতি সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন সেলিম বলেন, ‘‘আলমগীর খাঁ আমাদের উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য৷ তবে তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি আমার জানা নেই৷”
শিক্ষককে লাঞ্ছিতের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সদর উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের সাধারণ সম্পাদক রুবেল হাওলাদার বলেন, ‘‘শিক্ষককে এভাবে মারধর করা খুবই জঘন্য কাজ হয়েছে৷ অভিযুক্ত দেলোয়ার খাঁ ও তার সঙ্গে যারা জড়িত সকলের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি৷”
বাংলাদেশে শিক্ষকরা আজ নানাভাবে নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। শিক্ষক আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কারণ, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে যখন যা কিছু করতে পারে এখন। বর্তমান সমাজ শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতন, লাঞ্ছনা, হুমকি, ও কর্তব্য পালনে বাধা দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করতে হবে। যে জাতি শিক্ষককে সঠিক সম্মান দিতে পারবে না, সে জাতি তার উন্নয়নকে টেকসই করতে পারবে না। টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষকের নিরাপত্তা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দেখতে পাই, দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকরা নানাভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। ক্লাসে পড়াতে গেলে বা পরীক্ষা নিতে গেলে শিক্ষকরা আজ আর নিরাপদবোধ করেন না। কারণ, পরীক্ষার হলে নকল করতে দিতে হবে। নকল করতে না দিলে নানা ধরনের হুমকি চলে আসে।
আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষক খুন ও নির্যাতিত হওয়ার চিত্র দেখতে হচ্ছে। এগুলোকে সাধারণ অপরাধ হিসাবে দেখা ঠিক হবে না। বিচারের মাধ্যমে এসব অপরাধ দমনে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে এসব অপকর্ম চিরতরে বন্ধ হয়। জাতির কারিগর শিক্ষককে যে বা যারা শারীরিকভাবে আঘাত করতে পারে, তাদের পক্ষে যে কোনো ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটানো সম্ভব। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে।
একশ্রেণির মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করে উগ্রতা বা সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে চলেছে, যা অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। সুন্দর ও স্বাভাবিক শিক্ষাঙ্গন গড়ে তুলতে হলে উল্লিখিত অপরাধ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। একথা সত্য যে, শিক্ষকরাও অনেক সময় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েন। যেসব শিক্ষক অপরাধে জড়িত থাকবেন, তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮১৫
আপনার মতামত জানানঃ