যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত গত নির্বাচনের পর থেকেই গুঞ্জন চলছিল ট্রাম্প নতুন দল গড়তে যাচ্ছেন। এবিষয়ে অবশ্য ট্রাম্প আকার ইঙ্গিতে কিছু বললেও কখনো নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে এবার নতুন করে কোনও রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একইসাথে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান হয়ে তৃতীয়বারের মতো লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। গতকাল রবিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ফ্লোরিডায় অরল্যান্ডোর হায়াত রিজেন্সি হোটেলে রক্ষণশীলদের সম্মেলনে একথা জানান তিনি।
ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর হায়াত রিজেন্সি হোটেলে গত বৃহস্পতিবার(২৫ ফেব্রুয়ারি) রক্ষণশীলদের সম্মেলন শুরু হয়। গতকাল রোববার সম্মেলনের শেষ দিনের বক্তা ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আগের টানা তিন দিন রিপাবলিকান পার্টির রক্ষণশীল নেতারা সম্মেলনে বক্তব্য দেন। মঞ্চ গরম করেন ট্রাম্পের ছেলে ট্রাম্প জুনিয়র। রক্ষণশীল সিনেটর টেড ক্রুজসহ রিপাবলিকান পার্টির নানা পর্যায়ের লোকজনও সম্মেলনে বক্তব্য দেন।
ট্রাম্প বলেন, তিনি নিজে নতুন কোনো দল গঠন করবেন না। এসব ভুয়া খবরওয়ালাদের প্রচারণা।
ট্রাম্প বলেন, রক্ষণশীল আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালে কংগ্রেসের দখল নেবে রিপাবলিকান পার্টি। আর ২০২৪ সালে হোয়াইট হাউসও নিয়ন্ত্রণে আসবে রিপাবলিকান পার্টির।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন দল গঠন করলে রিপাবলিকান ভোট ভাগ হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একইসঙ্গে ফের ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্প বলেন,আসুন একটি নতুন পার্টি শুরু করি যাতে আমরা আমাদের ভোট ভাগ করতে পারি এবং কখনই জিততে না পারি। আমাদের রিপাবলিকান পার্টি আছে। এটি আগের তুলনায় ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী হতে চলেছে।
তিনি আরও বলেন, আসলে আপনি জানেন যে তারা কেবল হোয়াইট হাউসকে হারিয়েছে। তবে কে জানে আমি এমনকি তাদের তৃতীয়বারের জন্য পরাজিত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
জো বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম বারের মতো এমন সম্মেলনে এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনার কথা বলেন তিনি।
ট্রাম্প বলেন, ‘আপনাদের সহযোগিতায় আমরা আবার হাউজে (হোয়াইট হাউজে) ফিরবো। আমরা সিনেটেও জয়ী হবো এবং বিজয়ী হয়ে একজন রিপাবলিক্যান প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজে ফিরবেন। আমি ভাবছি, কে হবেন সেই ব্যক্তি?’ এরপর ট্রাম্প হেসে বলেন, ‘কে, কে, কে হবেন সেই ব্যক্তি, আমি ভাবছি।’
তিনি রিপাবলিকান পার্টির হয়েই লড়াইয়ে নামবেন। ট্রাম্প দাবি করেন, তৃতীয়বার ডেমোক্র্যাটদের হারানোর জন্য তিনি প্রস্তুত।
বহু সমালোচনার পরেও ট্রাম্প এদিন পরোক্ষে ফের দাবি করেছেন, নির্বাচনের ফলাফল পক্ষপাতদুষ্ট এবং তাতে কারচুপি হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, নির্বাচনে তিনি জিতেছেন। সে কারণেই তার বক্তব্য ২০২৪ সালে তৃতীয়বার তিনি ডেমোক্র্যাটদের হারাবেন।
জো বাইডেনের প্রশাসনের বয়স মাত্র দেড় মাস। এদিন ট্রাম্প সেই সদ্য তৈরি হওয়া সরকারকে ব্যর্থ বলে ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, তার আমলে কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের পাশপাশি রিপাবলিকানদের একাংশেরও সমালোচনা করেছেন তিনি।
আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার মাত্র ৪০ দিনের মাথায় আবার রাজনীতির মঞ্চ গরম করার প্রয়াস নিলেন। হোয়াইট হাউসে আসা নতুন প্রেসিডেন্টের সমালোচনাও করলেন ট্রাম্প নজিরবিহীনভাবে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্পর্কে ট্রাম্প বলেন, আমরা সকলেই জানতাম বাইডেন প্রশাসন খারাপ হতে চলেছে। তবে তারা কতটা খারাপ হবে এবং তারা কতদূর যেতে পারবে তা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, বাইডেন প্রশাসন কতটা খারাপ করবে। বাইডেন প্রশাসন কতটা বাম দিকে চলে যাবে, তা আমাদের ধারণারও বাইরে।’ ট্রাম্প এ কথা বলার সময় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা ব্যাপকভাবে হাততালি ও স্লোগান দিয়ে তার বক্তব্য সমর্থন করেন।
ট্রাম্প বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অভিবাসননীতি শুধু বেআইনিই নয়, তা অনৈতিক, হৃদয়হীন ও আমেরিকার মূল চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। বাইডেন প্রশাসন আমেরিকার স্কুলগুলো খুলে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
রক্ষণশীলদের এই সম্মেলনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবার গত নির্বাচনে তার জয় হয়েছে বলে দাবি করেন। তার এই বক্তব্যের প্রতি উপস্থিত সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন দেখা যায়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘চার বছর আগে যে মহান যাত্রা আমরা শুরু করেছিলাম, তা শেষ হয়ে যায়নি।’
বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেন, এই সমাবেশের সাহসী রিপাবলিকানরাই আগামী চার বছর নৈরাজ্যবাদী ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবে। এসব সাহসী রিপাবলিকানই ফেক নিউজ ও তাদের বাতিল সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এই লড়াইয়ে তিনি পাশে থাকবেন বলেন উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, ‘জয়ের জন্য যা প্রয়োজন, আমরা তা–ই করব।’
গত ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে নানা নাটকীয়তার জন্ম দেন ট্রাম্প। সে সময় নতুন রাজনৈতিক দল গড়ারও ইঙ্গিত আসে তার বক্তব্যে। ট্রাম্পের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্যাপিটল হিলে বিক্ষোভে অংশ নিতে গিয়ে নিহত হন বেশ কয়েকজন। অবশেষে ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন তিনি।
রোববার ট্রাম্প যখন কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সের (সিপ্যাক) মঞ্চে যোগ দেন, তখন তাকে পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন রিপাবলিকান পার্টির কর্মীরা। ‘ট্রাম্প, ট্রাম্প’ বলে স্লোগান দেন তারা। মঞ্চে প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান করেন ৭৪ বছর বয়সী এই সাবেক প্রেসিডেন্ট।
১৯৭৪ সাল থেকে শুরু হওয়া আমেরিকার রক্ষণশীলদের প্রভাবশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্স (সিপ্যাক) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। রক্ষণশীল ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক চাঁদাদাতাদের এই সম্মেলন রিপাবলিকান পার্টির নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রায় বিকল্পহীন হয়ে উঠেছে। আগে কখনো সিপ্যাক সম্মেলন কোনো একক রিপাবলিকান নেতাকে ঘিরে হয়নি। ২০১৬ সালের সিপ্যাক সম্মেলনে ট্রাম্প উপস্থিতই ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়ের আগে তাকে রিপাবলিকান পার্টির কোনো নীতিনির্ধারণী নেতা হিসেবে মনে করা হয়নি। কিন্তু আমেরিকার রাজনীতিতে রক্ষণশীলতা ও বিভাজন এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে এবারের সিপ্যাক সম্মেলন কার্যত ট্রাম্পকে ঘিরেই হয়েছে।
অভিশংসন বিচার থেকে খালাস পাওয়ার সপ্তাহখানেক পর ট্রাম্প এ বক্তৃতা দিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, নতুন করে কোনো রাজনৈতিক দল তিনি গড়বেন না। এতে করে রিপাবলিকান পার্টি দুর্বল হয়ে পড়বে। বরং নিজ দলকে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী করতে চান।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রিপাবলিকান পার্টি থেকে ট্রাম্পকে সমর্থন না দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা, ক্যাপিটল হিলে ঘটে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কলঙ্কময় এক ইতিহাসের রচয়িতা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তখনই রিপাবলিকানের শীর্ষস্থানীয় নেতারা চলে গিয়েছিলেন। ট্রাম্পের এই হীন কাজের জন্য প্রকাশ্যে বিরুদ্ধচারণ করেছেন। এমনকি ট্রাম্পের অভিশংসনের ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্প পুনরায় যদিও রিপাবলিকান হয়ে লড়েন তবে রিপাবলিকান পার্টির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই দল ছাড়তে পারেন বলে আশঙ্কা। দলের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অবস্থান ও প্রকাশ্য সমালোচনা ট্রাম্পকে দল থেকে আরো কোণঠাসা করে তুলেছে। বিশ্লেষকরা জানান, জনগণের মাঝে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার কমতি অতোটা না হলেও নিজ দলের নেতাকর্মীদের নিকট ট্রাম্প জনপ্রিয়তা হারিয়ে অনেকটাই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাছাড়া ক্যাপিটল হিল কলঙ্কের পর রিপাবলিকানরা ট্রাম্পের হাতে নেতৃত্ব দেবে কিনা সেবিষয়েও রয়েছে সংশয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৬
আপনার মতামত জানানঃ