সন্ত্রাসবাদের কথা উঠলেই সাধারণত চোখ চলে যায় মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা বা দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে, সন্ত্রাসবাদের অন্যতম ধারক ও বাহক ছিল পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজেই। কলোনি প্রতিষ্ঠার সময় থেকে শুরু করে আধুনিক ভূরাজনীতিতে পশ্চিমারা বরাবরই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে একটি বৈধ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আর এই ঐতিহ্যের আধুনিক এক প্রতীক হয়ে উঠেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প — আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, যিনি কেবল রাজনৈতিক বিভাজন নয়, বর্বরতা ও ঘৃণার রাজনীতিকেও বৈধতা দিয়েছেন।
ইউরোপ যখন ১৫শ শতকে “আবিষ্কার” শুরু করল নতুন নতুন ভূখণ্ড, তখন সেটি কোনো কৌতূহলবশত ছিল না, ছিল নিছক লোভ ও কর্তৃত্বের খেলা। আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারতবর্ষ— সর্বত্র তারা প্রবেশ করেছিল উন্নয়ন আর সভ্যতা দেওয়ার নামে। কিন্তু বাস্তবে তারা করেছিল ধ্বংস, লুণ্ঠন ও সাংস্কৃতিক গনহত্যা।
ভারতে ব্রিটিশরা পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে কৌশলে ক্ষমতা দখল করে পুরো উপমহাদেশে দারিদ্র্যের পাহাড় তৈরি করেছিল। হাজার হাজার মানুষ তাদের পলিসির কারণে দুর্ভিক্ষে মারা যায়। একে কী বলা যায়? রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নয়?
আফ্রিকায় কঙ্গোর মানুষদের হাত কেটে নেওয়া হয়েছিল শুধু কাঁচামালের কোটা পূরণ না করায়। আমেরিকাতে লক্ষ লক্ষ আদিবাসীকে হত্যা করে বসানো হয়েছিল “ডেমোক্রেসি”। এসবই ছিল সন্ত্রাস— পশ্চিমা সন্ত্রাস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বদুই ভাগে বিভক্ত হয় — পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র। এই সময়েও আমেরিকা-যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স-ইসরায়েল গোপনে ও প্রকাশ্যে সন্ত্রাসবাদ চালিয়ে গেছে। ইরানের মোসাদ্দেক সরকারকে সরিয়ে দিয়ে শা’কে বসানো, চিলির অ্যালেন্দেকে হত্যা করে পিনোশেটকে ক্ষমতায় আনা, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে তালেবান তৈরিতে সিআইএর ভূমিকা — সবই তথাকথিত ‘ডেমোক্রেসি এক্সপোর্ট’-এর নামে।
আর এই ঐতিহ্যের আধুনিক এক প্রতীক হয়ে উঠেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প — আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, যিনি কেবল রাজনৈতিক বিভাজন নয়, বর্বরতা ও ঘৃণার রাজনীতিকেও বৈধতা দিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনীতি ছিল চরম ডানপন্থার ও বর্ণবাদে মোড়ানো। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসলামবিদ্বেষ, অভিবাসন বিরোধিতা এবং বৈশ্বিক হুমকির ভাষা ব্যবহার করে এক ধরনের ‘মডার্ন সন্ত্রাস’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে সীমান্তে শিশুদের আলাদা করে বন্দী রাখা হয়, মুসলিম নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে ট্রাম্প কার্যত একটি বর্বর রূপরেখা তৈরিতে সহায়তা করেন।
২০২০ সালে ‘Black Lives Matter’ আন্দোলন চলাকালে ট্রাম্প রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করেন, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চরম সহিংসতার উদাহরণ। এর পাশাপাশি তিনি ৬ জানুয়ারি ২০২১ সালে ক্যাপিটল হিলে যেসব সমর্থকরা হামলা চালায়, তাদের উদ্দেশ্যে ‘We love you’ বলে সন্ত্রাসকে উসকে দেন।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পশ্চিমা সন্ত্রাসকে কখনো মিডিয়া “সন্ত্রাস” বলে আখ্যায়িত করে না। তাদের ভাষায় এটি “আত্মরক্ষা”, “বিকল্প ব্যবস্থা” কিংবা “শান্তি আনার প্রচেষ্টা”। বিপরীতে, একটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরোধকেও “সন্ত্রাস” বলে প্রচার করা হয়।
ট্রাম্পের মতবাদের বিস্তার শুধুমাত্র আমেরিকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ভারতে মোদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, ব্রাজিলে বলসোনারো, হাঙ্গেরিতে ওর্বান— এরা সবাই এক ধরনের ট্রাম্পীয় নীতি অনুসরণ করে নিজেদের দেশে ফ্যাসিবাদ ও সংখ্যালঘুবিরোধী রাজনীতি চাপিয়ে দিয়েছেন। ফলে একে একে বিভিন্ন অঞ্চলে এই ‘পশ্চিমা সন্ত্রাস’ নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সন্ত্রাসবাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতিমালার একটি জটিল ও বিতর্কিত ইতিহাস রয়েছে। তিনি ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই সন্ত্রাসবাদকে মার্কিন জনগণের কাছে একটি মূল ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেন। তবে তার ভাষ্য এবং নীতিগত অবস্থান অনেক ক্ষেত্রেই সরলীকৃত, বিভ্রান্তিকর এবং ইসলামবিদ্বেষী বলে সমালোচিত হয়েছে। তার পুরো সন্ত্রাসবাদবিরোধী অবস্থান অনেকাংশেই ‘মুসলিমদের থেকে আসা হুমকি’ হিসেবে একতরফাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু বাস্তবতা থেকে দূরে ছিল না, বরং এটা গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এক ধরণের অবিশ্বাসের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন “মুসলিম ব্যান” নামে পরিচিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, যেটি সাতটি প্রধানত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। যদিও ট্রাম্প এই নিষেধাজ্ঞাকে “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা” হিসেবে দাবি করেছিলেন, বাস্তবে এই নীতির কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে জড়িত বেশিরভাগ ব্যক্তি আমেরিকারই নাগরিক বা দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী ছিল, অথচ নিষিদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে এদের কোনো সরাসরি যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। ফলে এই নিষেধাজ্ঞা বরং এক প্রকার রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অর্জনের হাতিয়ার ছিল, যেখানে নিরাপত্তার বাস্তবিক চিত্র উপেক্ষিত হয়েছে।
ট্রাম্পের কথাবার্তায় প্রায়ই দেখা গেছে যে, তিনি সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞাকে নিজের রাজনৈতিক সুবিধামতো ব্যবহার করেছেন। যেমন, তিনি শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থীদের কর্মকাণ্ডকে খুব কম ক্ষেত্রেই “সন্ত্রাসবাদ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহু প্রাণঘাতী হামলার পেছনে এই ধরনের চরমপন্থীদেরই হাত ছিল। ২০১৭ সালে ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে নব্য-নাৎসি ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সহিংস সমাবেশে একজন নারী নিহত হওয়ার পরও ট্রাম্প বলেছিলেন, “দুই পক্ষেই ভালো মানুষ আছে।” এই মন্তব্য প্রমাণ করে, তার দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা ছিল পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ট্রাম্প প্রশাসন সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় মূলত প্রতিরক্ষা ব্যয় ও গোয়েন্দা নজরদারির উপর জোর দিয়েছে, কিন্তু গোঁড়ামি, সামাজিক বঞ্চনা কিংবা অভ্যন্তরীণ চরমপন্থার মতো গভীর সামাজিক কারণগুলো উপেক্ষা করেছে। অথচ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্ক করেছেন যে, অভ্যন্তরীণ ঘৃণার সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক মেরুকরণই অনেক সময় চরমপন্থাকে উসকে দেয়। ট্রাম্পের বিভাজনমূলক বক্তব্য ও নীতির মাধ্যমে এই পরিবেশ আরও ঘনীভূত হয়েছে, যা সন্ত্রাসবাদ রোধের চেয়ে বরং উস্কে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
আন্তর্জাতিক পরিসরেও ট্রাম্পের সন্ত্রাসবাদবিরোধী নীতির সাফল্য ছিল সীমিত। তিনি আফগানিস্তান থেকে দ্রুত সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে তালেবানের হাতে দেশটি তুলে দিয়েছেন, যা অনেক বিশ্লেষকের মতে সন্ত্রাসীদের জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। এছাড়া, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অবস্থান অনেকাংশে দুর্বল করে ফেলেন, যা আইএস বা আল-কায়েদার মতো সংগঠনগুলোকে পুনর্গঠনের সুযোগ দিতে পারে। তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতাকেও দুর্বল করেছে।
ট্রাম্পের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানকে অনেকেই রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে দেখেন। তার কথাবার্তা ও নীতিতে কৌশলগত গভীরতা বা বিস্তৃত নিরাপত্তা-চিন্তার অভাব ছিল প্রকট। ফলে বাস্তবিক নিরাপত্তা জোরদার না হয়ে বরং বিভাজন, বৈষম্য ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি বেড়েছে, যা চরমপন্থা দমনের ক্ষেত্রে একটি মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা।
সন্ত্রাস মানে শুধু বোমা নয়। সন্ত্রাস মানে ঘৃণা ছড়ানো, গণতন্ত্র ধ্বংস করা, সাধারণ নাগরিকদের আতঙ্কিত করা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে সহিংসতা ও বৈষম্যকে বৈধতা দেওয়া।
এই দিক দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসবাদের একটি মুখ— আধুনিক, কৌশলী, মিডিয়া-বান্ধব কিন্তু ভেতরে ভয়ঙ্কর বিভাজনের কারিগর। তার রাজনীতির ভিত্তি ছিল ভয়, তার প্রচারণা ছিল ঘৃণায় পূর্ণ, এবং তার শাসন ছিল সমাজের দুর্বলদের প্রতি সহিংস।
তিনি যদি বোমা নিয়ে পথে নামতেন, তাহলে হয়তো তাকে ‘সন্ত্রাসী’ বলার সাহস হতো সবার। কিন্তু তিনি কোর্ট-টাই পরা, সাদা চামড়ার, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর বলে তার সন্ত্রাসকে “নীতি” আর তাকে “লিডার” বলা হয়। এটাই আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক বাস্তবতা।
আপনার মতামত জানানঃ