Nash Colundalur
দক্ষিণভারতে ‘দেবদাসী’ নামের এক অদ্ভুত বর্বর প্রথা চালু আছে যে ব্যবস্থায় একটা মেয়ে শিশুকে মন্দিরে উৎসর্গ করে দিতে হয়। বাস্তবে মেয়েটি হয়ে যায় ধর্মের নামে মন্দিরের পুরোহিত, সমাজের উঁচু স্থানের মানুষের স্বল্পমূল্যের আজীবন যৌনদাসী। দেবদাসী হিসেবে কন্যাশিশুর উৎসর্গ করার রীতিকে ভারতের সরকার ১৯৮৮ সালে আইনত নিষিদ্ধ করলেও গোচরে অগোচরে সমাজপতিদের সহায়তায় এই অমানবিক কর্মকাণ্ড চলছেই।
প্রভাতাম্মা এরকমই একজন দেবদাসী, ধর্মগুরুগণ বড় গলায় নাম দিয়েছেন ‘ঈশ্বরের সেবক’ দেবদাসী। তার গলায় দেখা যায় লাল-সাদা পাথরের মালা। প্রভাতাম্মাকে মাত্র ১০ বছর বয়সেই দক্ষিণ ভারতের সুনদাত্তি মন্দিরের ‘ইয়েল্লাম্মা’ দেবীর পায়ে উৎসর্গ করা হয়। ফলে সে আর কোনদিন কোন জাগতিক মানবকে বিয়ে করতে পারবে না। প্রভাতাম্মা যখন বয়ঃসন্ধিক্ষণে পৌঁছান তখন বুঝতে পারলেন দেবদাসী ঐতিহ্য অনুযায়ী তার কুমারিত্ব সর্বোচ্চ নিলামে বিক্রি হয়ে গেছে এবং তার কন্যাশিশুটিকেও মাত্র ১৪ বছর বয়সে জোরপূর্বক মুম্বাইয়ের পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়।
প্রভাতাম্মা মন্দিরে থাকতেই বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন কিন্তু বাড়িতে আসার কোন অধিকার তার ছিল না। তার নিজের সন্তানকে বছরের পর বছর ধরে হয়ত কয়েকবার দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এখন তার বয়স মাত্র ২৬ এবং এর মধ্যেই তার শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ও সামাজিক ট্যাবু এইডসের জীবাণু এবং নিজ গ্রাম মুধলে ফিরে গেছেন। সে এখন শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল এবং কাজ করতে পারে না। প্রভাতাম্মা বলেন, “আমরা অভিশপ্ত এবং নির্যাতিত শ্রেণির মানুষ, পুরুষ আমাদেরকে ব্যবহার করে এবং প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।” তার মেয়ের ছোট্ট শরীরে ট্যালকম পাউডার মাখাতে মাখাতে এবং মাথায় রঙিন রিবন বেঁধে দিতে দিতে বলছিলেন, “আমি তো অল্প কিছুদিন পরেই মরে যাবো, তখন কে আমার মেয়েটিকে দেখে রাখবে?” প্রভাতাম্মা নিজেও ইয়েল্লাম্মা দেবীর মন্দিরে কন্যাশিশু উৎসর্গ করার নিষিদ্ধ অপসংস্কৃতি থেকে বেরোতে পারেন নি, সে তার কন্যাকে মন্দিরে উৎসর্গ করে দেবার কথা ভাবছেন। সামাজিক প্রথা যত খারাপই হোক না কেন তার নাগপাশ থেকে বেরোনো এত সহজ নয়। ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন রকম শিকলে বাঁধা দরিদ্র জীবন।
প্রতি জানুয়ারিতে প্রায় পাঁচলক্ষ ভক্ত কর্নাটকের অদূরে ছোট্ট শহর সুনদাত্তির হিন্দু ধর্মের (এলাকাভিত্তিক দেবী) উর্বরতার দেবী ইয়েল্লাম্মা’র (রেণুকা) মন্দিরে উৎসবে সমবেত হয় আশির্বাদের প্রত্যাশায় মন্দিরের প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে শহরের রাস্তায় উপচে পড়ে ভক্তদের ভীড়ে, দোকানিরা ভক্তদের জন্য সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখে পুজোর অর্ঘ্য, উপাচার, কাঁচ বা পুঁথির মালা, হাতের বালা, ব্রেসলেট, নারকেল, রংবেরংয়ের কুমকুম, কপালের তিলক। মন্দিরের বয়ষ্ক নারীদেরকে বলে “যোগাথিস” এবং বলা হয়ে থাকে তারা মানুষ এবং দেবীর মাঝে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে কাজ করেন। তারা প্রায় সবাই দেবদাসী হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন এবং এই মন্দির থেকেই তার ক্লান্তিকর জীবনের উদ্বোধন।
সাধারণত হিন্দুদের দলিত, অচ্ছুৎ বা নিম্নবর্ণের গরিব পরিবারের কন্যাশিশুকে চার বছর বয়সেই ইয়েল্লাম্মা দেবীর পায়ে উৎসর্গ করে দেয়া হয়। এইসব শিশুরা আর কেউকে বিয়ে করতে পারে না, তারা মন্দিরে থেকে দেবীর (সমাজের কুলীন শ্রেণির) সেবা করে কাটিয়ে দেবে আজীবন। দক্ষিণ ভারতে মন্দির ভিত্তিক দেবদাসী প্রথা চলে আসছে শত শত বছর ধরে। ধর্মের পুণ্য মোড়কে চলছে ধনী লোকদের উপপত্নী সরবরাহের ব্যবস্থা। ধ্রুপদী নাচে, গানে, বাদ্যে পারদর্শী দেবদাসীদের যৌবন যতদিন আছে ততদিন গ্রামের ধনী কুলীন শ্রেণির সমাজপতিদের দেয়া আরামদায়ক বাড়িতে তাদের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত নিয়ে সমস্যা হয় না। ১৯৮৮ সালে ভারতের আইনসভায় দেবদাসী ব্যবস্থা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে মন্দির দেবদাসীদের সাথে প্রকাশ্য সম্পর্ক এড়িয়ে চলে, কিন্তু গোপনে ঠিকই চলে এমন কুপ্রথার প্রচলন।
ব্রিটিশ উপনিবেশ পত্তনের পর থেকে পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করে। ইতিহাসের পাঠক, গবেষক, সমাজ হিতৈষী সবাই দেবদাসী প্রথার বিরোধিতা করে আসছিলেন। ব্রিটিশ প্রশাসন মনে করেছিল দেবদাসী বুঝি ধর্মীয় প্রথা, যদিও ব্রিটিশ শাসনের কারণেই মন্দির ও দেবদাসী ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকগণ মনে করছিলেন তারা ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক প্রভাব হারাচ্ছিলেন। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত বাবা-মা তাদের দারিদ্র্যের বোঝা লাঘব করতে তাদের কন্যাশিশুকে মন্দিরে উৎসর্গ করে। এতে একই সাথে দুইটা উদ্দেশ্য পূরণ হয়। প্রথমত যদিও কন্যাশিশুদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা তারা জানে, তবুও ধর্মীয় মলম তাদের অনুশোচনার ঘায়ে স্বান্তনার মলম হিসেবে কাজ করে দ্বিতীয়ত, কন্যা মন্দিরে দিলে কিছু টাকা পাওয়া যায় এবং মেয়েটিও ভবিষ্যতে পরিবারকে টাকা দিয়ে সাহায্য করে।
১৬ বছরের রূপা ইয়েল্লাম্মা দেবীর পুজোর মেলায় এসেছে কিছু প্রসাধনী এবং অলংকার কিনতে। মাত্র ৭ বছর বয়সের সময় রূপার পরিবার তাকে ইয়েল্লাম্মা দেবীর মন্দিরে উৎসর্গ করে দেয় এবং সবাই আশ্বাস দেয় নিশ্চয়ই দেবী তাকে রক্ষা করবেন। গ্রামে তার কুমারিত্ব নিলামে ওঠে এবং সেই থেকে চলছে দেবীর মন্দিরে সেবাদাসীর আড়াল পরিচয়ে বেশ্যাবৃত্তি। গতর বেচা টাকা দিয়ে সুনদাত্তি গ্রামে তার পরিবারকে সাহায্য করে আসছে এতদিন।
রূপা স্বীকারোক্তি দেয়, প্রথম প্রথম তার খুব যন্ত্রণা হতো। প্রথমবার যেদিন কোন পুরুষ তার সাথে যৌনসঙ্গম করে সেদিন আক্ষরিক অর্থেই তার মনে হয়েছিল তার যৌনাঙ্গ বুঝি ব্লেডের আঘাতে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য দেবদাসীদের মতই তার জীবনেও ঘোর অমানিশার অন্ধকার সুড়ঙ্গ যেখানে নেই কোন আশার আলো। যৌবনের ভাটি বেলায় আস্তে আস্তে কমতে থাকে তাদের চাহিদা আর ৪৫ বছর হয়ে গেলে তো তাদেরকে আর কেউ বিছানায় ডাকেই না। তখন তারা সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কোনক্রমে কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করে, কেউ কেউ যোগী হয়ে মন্দিরের পাশের ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে।
চেন্নাবা এখন ৬৫ বছরের অশতিপর বৃদ্ধা এবং চোখে দেখতে পান না। মন্দিরে আসা দর্শনার্থীদের কৃপায় জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। চেন্নাবা বলেন, “মাত্র ১২ বছর বয়সে, অথচ ইয়েল্লাম্মা দেবীর মন্দিরে থাকতে হবে শুনে প্রথমে খুশি হয়েছিলাম। এরপরে তো দেহ পসারের টাকা দিয়ে আমার মা, বোন, ভাইদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু আমার বর্তমান অবস্থা দেখেন। নিঃস্ব আমি”। বৃদ্ধা মাঝেমধ্যে অন্ধ চোখে হাতড়ে ভিক্ষার বাটি দেখে, কেউ ছুঁড়ে দিলো কিনা দুই একটা সিকি আধুলি পয়সা। আমার মা নিজেও একজন দেবদাসী ছিলেন। তিনিই আমাকে ইয়েল্লাম্মা দেবীর মন্দিরে উৎসর্গ করেছিলেন এবং আসলে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন মানুষের লাথিঝাঁটা, প্রহার এবং ধর্ষিত হওয়ার জন্য। এই ঈশ্বর আমার জন্য অভিশাপ, আমি তাকে কখনো চাইনি বরং এখন মরণের প্রতীক্ষা।
দেবদাসী প্রথা বাতিলের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা “বিমোচন” এনজিওর প্রতিষ্ঠাতা বি.এল পাতিল বলেন, “যদিও ইয়েল্লাম্মা দেবীর উদ্দেশ্যে কন্যা শিশু উৎসর্গ করার প্রথা আইনত নিষিদ্ধ কিন্তু এখনো কন্যাশিশুর পরিবার, মন্দিরের পুরোহিত এবং সমাজপতিদের যোগসাজশে চলছেই এই অমানবিক কাজটি লোক চক্ষুর অন্তরালে। দ্য ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন ধারণা করছে ভারতে এখন প্রায় ৪৮,৩৫৮ জন দেবদাসী আছেন।”
বি. এল পাতিল বলেন, “বঞ্চনার জীবন যাপন সরকার ঘোষিত শিডিউল কাস্ট (নিম্নবর্ণের হিন্দু) হিন্দুদের নিয়তি হয়ে গেছে যা তাদের চাপিয়ে দিয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুসমাজ। মন্দিরের পুরোহিত নিজেদের বাড়িতেই নিম্নবর্ণের হিন্দু মেয়েদের দেবদাসী করার আয়োজন করে থাকেন অত্যন্ত গোপনে। কোন মেয়েকে দেবদাসী বানাতে পারলে ওই পুরোহিতেরও লাভ ষোল আনা।” তারও সুযোগ আসে মেয়েটির সাথে যৌন সঙ্গমের এবং ধনীদের কাছ থেকে দুই পয়সা আয়ের পথ। বি. এল পাতিল বিমোচনা এনজিও’র যাত্রা শুরু করেন প্রথমত দেবদাসীর সন্তানদেরকে দেবদাসী বানানো বন্ধ করতে। তিনি ২১ বছর আগে তার নিজ বাসভূমিতে দেবদাসী নারীদের সন্তানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চেয়েছিলেন দেবদাসীর সন্তান যেন আর দেহপসারের বেড়াজালে আবদ্ধ না হয়। তাই তাদেরকে শিক্ষক, নার্সের ইত্যাদি পেশায় পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন। বি.এল পাতিলের কাজের পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্থানীয় এবং প্রভাবশালী প্রতিবেশীদের থেকে প্রবল বাধা বিপত্তি আসতে লাগল। কেউ তাদের সন্তানদেরকে বেশ্যার অচ্ছুত সন্তানদের সাথে পড়ালেখা করতে দিতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু এখন স্কুলটিতে ৭০০ ছেলেমেয়ে শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছে এবং স্কুলের কলেবরে যোগ হয়েছে কয়েকটি নতুন ভবন। এখান শিক্ষাগ্রহণ করে প্রায় ৩০০ মেয়ে বিয়ে করে সমাজের মূলধারার সাথে মিশে যেতে পেরেছে।
রূপা জানে না তার এখন ভবিষ্যৎ কী। রূপা বলেন, “যদিও তিনি তার শরীরে বিভিন্ন পুরুষের স্পর্শ ঘৃণা করেন কিন্তু বিভিন্ন পুরুষের কাছে শরীর বেচা টাকা দিয়েই তার মা এবং ভাইবোনের সংসার চলে। আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে আসছে। মন্দিরের রাস্তায় চেন্নাবা’র পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রূপা বলতে থাকেন, আমি যখন চেন্নাবার মত অচল হয়ে যাবো, হয়ত অন্ধ হয়ে যাবো তখন আমাকেও হয়ত তার সাথে ভিক্ষা করতে হবে।”
রূপা অন্ধ চেন্নাবার হাতে কিছু খাবার তুলে দেন। ভবিষ্যতে আমাকেও হয়ত কোন দেবদাসী আজকের মত খাবার দিয়ে সাহায্য করবে। ইয়েল্লাম্মা দেবীর কাছে আম্র কোন প্রত্যাশা নেই এখন আর। মেলার দোকান থেকে নতুন কেনা বালা হাতে পরে নিজেই যেন মুগ্ধ হয়ে দেখে নিলেন নিজেকে এবং বললেন যাই তাহলে, আমার কাজের সময় হয়ে গেছে।
ভাষান্তর : বিকাশ মজুমদার
লেখক : Nash Colundalur, ভারতীয় সাংবাদিক ও স্থপতি, গার্ডিয়ান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সাংবাদিকতা পুরুস্কার বিজয়ী।
আপনার মতামত জানানঃ