বিকাশ মজুমদার
হিন্দুদের বর্ণপ্রথা সম্ভবত এই প্রাচীন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সবথেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন সংস্কার। হিন্দু ধর্মের বহুবিধ কুসংস্কার, বর্বর প্রথা রহিত করা গেলেও বর্ণপ্রথা এখনো টিকে আছে সগৌরবে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই বিভাজন বন্ধ হওয়ার কোন সম্ভবনা নাই। বর্ণপ্রথা হলো হিন্দুধর্মের অন্তরে ফল্গু নদীর মত অন্তঃসলিলা হিংসা ও ঘৃণার স্রোতধারা। প্রায় ৩০০০ বছর আগে মনু নামের এক বৈদিক ঋষি হিন্দু সমাজে বর্ণবিভাজন চাপিয়ে দেন। মনু লিখিত জীবনাচরণকে মনুসংহিতা বলে যেটা শ্রুতি (কানে শোনা) ও স্মৃতির (মনে রাখা) মাধ্যমে বংশপরম্পরায় বয়ে যাচ্ছে এখনো।
কর্মানুসারে হিন্দুরা হিন্দুধর্মের বর্ণান্ধতা প্রাপ্ত হয় উত্তরাধিকার সূত্রে যা একজন হিন্দু আর কোনদিন পরিবর্তন করতে পারে না। অর্থাৎ একজন উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রাহ্মণ হলে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অধঃপাতে গেলেও তাদের মাঝে ব্রাহ্মণ্যবাদ সঞ্চার করতে পারবে, তেমনি একজন শুদ্র লেখাপড়া, জ্ঞানার্জন করে কোনভাবে পারিবারিক পেশা পরিবর্তন করতে পারলেও বর্ণ পরিবর্তন করতে পারবে না। শিক্ষা, জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার চূড়ান্ত শিখরে উঠে গেলেও সে আজীবন শুদ্রই থেকে যাবে। মনুসংহিতানুসারে বর্ণ অনুযায়ী কর্ম নির্দিষ্ট কিন্তু মোগল ও ব্রিটিশ শাসনামলে এটি সুসংগঠিত এবং অপরিবর্তনশীল কঠোর সামাজিক প্রথায় পরিণত হয়। কারণ কঠোর সামাজিক অনুশাসনের ফলে বিভেদ সৃষ্টি করা গেলে এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যাকে শাসন ও শোষণ করা সহজতর হয়। প্রকৃতপক্ষে বর্ণপ্রথা হলো মানুষকে শাসন ও শোষণ করার প্রশাসনিক মেকানিজম এবং এই কুব্যবস্থার বিষবৃক্ষকে শুধু শাসন করার সুবিধার্থে হিন্দু রাজা, মোগল শাসক, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সবাই মিলেই ফুলে ফলে, পত্রপল্লবে শিকড়ে শাখায় বিকশিত করেছিল। সমাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে পৌছে গিয়েছিল বর্ণপ্রথার বিষবাষ্প যা থেকে হিন্দু সমাজ এখনো পরিত্রাণ পায়নি এবং বর্তমানে তারা নিজেরাও এই ঘৃণা চর্চা থেকে বেরোতে চায় না। হিন্দু ধর্মীয় নেতারাও বিভাজনের ঘোলা জলে মাছ শিকারের মত সামাজিক উচ্চস্থান নিজেদের দখলে রাখতে বর্ণপ্রথার আগুনে বাতাস দিয়ে যাচ্ছেন।
হিন্দুদের প্রধানত চারটি বর্ণ রয়েছে যথাক্রমে – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র। মনুসংহিতাতে উল্লেখ পাওয়া যায় পুরাণ অনুসারে হিন্দুরা মনে করে সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার মাথা থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং পদযুগল থেকে শুদ্রের জন্ম। এছাড়া ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারদের আনুকূল্যে বাইপ্রোডাক্টের মত কেরানী শ্রেণির আরেকটি বর্ণের জন্ম হয় যাদেরকে “কায়স্থ” বলে এবং যারা নিজেদেরকে উঁচু শ্রেণির হিসেবে দাবি করতে থাকে। যেহেতু সমাজে অর্থই সর্বার্থ এবং অনর্থের মূল এবং ইতিমধ্যেই এই কেরানী শ্রেণি শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে গিয়েছিল সেহেতু তাদের উচ্চবর্ণের দাবী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। কিন্তু প্রাচীন হিন্দু সমাজ মুচি, ডোম, ঝাড়ুদার, মেথর ইত্যাদি পেশাজীবীদেরকে কোন বর্ণের স্বীকৃতিও দেয় নি। উচ্চবর্ণের অবহেলায় এরা হয়ে গেছে অচ্ছুৎ, দলিত শ্রেণির কমদামী মানুষ। নিজের ধর্মেই বর্ণের অন্ধকারে তারা চিরকাল নিষ্পেষিত হয়ে আসছে।
হিন্দু মিথোলজি অনুযায়ী সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার মাথা থেকে উদ্ভূত বলেই হয়ত বর্ণের শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঠন পাঠোন, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ, রাজার মন্ত্রীসভার পরামর্শদাতা এবং অন্যান্য বর্ণের হিন্দুদের পুজো ও সামাজিক অনুষ্ঠানের পুরোহিত হিসেব কাজ করতো এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা সমাজপতি। বর্ণভেদের দ্বিতীয় স্তরে আছে ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় শ্রেণি মূলত যোদ্ধা এবং রাজ্য পরিচালনা ও শাসনে নিয়োজিত। বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশ রক্ষা এবং প্রজার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ক্ষত্রিয়ের দায়িত্ব। ক্ষত্রিয় শ্রেণির জন্ম হয়েছে ব্রহ্মার বাহু থেকে। এরপরেই আছে বৈশ্য শ্রেণি যাদের জন্ম ব্রহ্মার উরু থেকে। ব্যবসা বাণিজ্য, কারুশিল্প, গবাদি লালন পালন ইত্যাদি অর্থকরী বৈশ্য শ্রেণির কাজ। ব্রহ্মার পা থেকে উদ্ভূত শুদ্র শ্রেণির এবং শুদ্র সমাজের সেবামূলক, কায়িক পরিশ্রম, কৃষিকাজের জন্য নিয়োজিত। পেশা বিবেচনায় চারটি বর্ণকে প্রায় ৩০০০ ভাগ এবং প্রায় ২৫,০০০ উপশ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে।
বর্ণ বিভাজন কীভাবে কাজ করেঃ
হাজার বছর ধরে বর্ণপ্রথা হিন্দুদের ধর্ম ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষায় অগ্রগতি, নগরায়নের কারণে বর্ণের বিদ্বেষ কিছুটা কমেছে, মাঝে মাঝে আন্তঃবর্ণের বিয়ের দেখাও মেলে। ফলে শহরে বর্ণভেদের বিভাজন ছাইচাপা আগুনের মত লুকায়িত থাকলেও গ্রামে এই ঘৃণ্য প্রথার প্রভাব খুব তীব্র। তবে শহরেও জাতপাত প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠে যখন বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক ও অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ সামনে আসে। গ্রামে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বাজারে, হোটেলে খেতে পারলেও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে এক বৈঠকে অন্নগ্রহণ করে না। এতে তাদের কৌলীন্য চলে যায়। অতীতে শহরে উচ্চবর্ণ এবং নিম্নবর্ণের জন্য আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল। বর্ণপ্রথা উচ্চবর্ণকে সবধরণের সামাজিক সুযোগ সুবিধার অধিকারী করলেও নিম্ন বর্ণের উপর আরোপিত হয়েছে বিভিন্ন অবরোধ আর নিষেধাজ্ঞা। উচ্চবর্ণের জলাধার স্পর্শ করার অধিকার নিম্নবর্ণের ছিল না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য শ্রেনিও শুদ্রের স্পর্শ করা খাবার, জল গ্রহণ করত না, এমনকি শুদ্রের ছায়া মাড়ালে ব্রাহ্মণকে স্নান করে শুচি হওয়া লাগত একটা সময়ে। এক বর্ণের সাথে অন্য বর্ণের বিয়ে নিষিদ্ধ, গীতায় বর্ণিত আছে আন্তঃবর্ণের মধ্যে বিয়ে হলে যে সন্তান উৎপাদন হয় তারা হবে বর্ণ সংকর।
অতীতে বিভিন্ন সময় বর্ণপ্রথার সমালোচনা হয়েছে বর্তমানেও এই সামাজিক বিভাজন প্রথার সমালোচনা চলছে। হিন্দুদের সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা গেছে, বিধবা বিবাহ চালু করা গেছে, বিধবা নারী স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী হয়েছে, কন্যাসন্তানও পিতার সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার পেয়েছে কিন্তু বর্ণপ্রথা এখনো টিকে আছে। হিন্দুরা কবে এই সামাজিক অভিশাপের নাগ পাশ থেকে মুক্তি পাবে তারও কোন দিক নিশানা নেই। নেই কোন সমাজ সংস্কারক যিনি এই হিংসাত্মক বিভাজন প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন।
হিন্দু ধর্মে দলিত শ্রেণির সামাজিক অবস্থানঃ
প্রাচীন হিন্দু সমাজ হিন্দুদের গুণ ও কর্ম বিবেচনায় চারটি বর্ণের সামাজিক অবস্থান ও স্বীকৃতি থাকলেও মুচি, ডোম, ঝাড়ুদার, মেথর ইত্যাদি পেশাজীবীদেরকে কোন বর্ণের স্বীকৃতিও দেয় নি। উচ্চ বর্ণের অবহেলায় এরা হয়ে গেছে অচ্ছুৎ, দলিত শ্রেণির কমদামী মানুষ। নিজের ধর্মেই বর্ণের অন্ধকারে তারা চিরকাল নিষ্পেষিত হয়ে আসছে বংশপরম্পরায়। যেহেতু বর্ণ ব্যবস্থা অপরিবর্তনীয় এবং হিন্দুরা উত্তরাধিকার সূত্রে বর্ণত্ব প্রাপ্ত হয় সেহেতু একজন দলিতের জন্য শিক্ষা দীক্ষার সুযোগ সীমিত। ব্রিটিশ শাসনামলে তো শিক্ষার তেমন সুযোগই ছিল না। শিক্ষিত হয়ে গেলে তারা আর পৈত্রিক পেশায় যুক্ত থাকবে না এই আশংকায় তাদের শিক্ষগ্রহণকে নিরুৎসাহিত এবং সংকুচিত করা হয়েছে। জোর করে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে অমানবিক নিয়মকানুন ও অবিবেচক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিধি নিষেধ। তাদের বসবাসের জায়গাও ছিল শহর থেকে কিছুটা দূরে নির্দিষ্ট জায়গায়। দলিত শ্রেণিকে যাতে সহজেই চিহ্নিত করা যায় সেজন্য তারা সাথে বহন করত ধাতব ঘন্টা, পানীয়জল, চা বা অন্যান্য পানের জন্য একটা ঘটি এবং বসার জন্য একটা মাদুর। ঘন্টার শব্দে সবাই বুঝতে পারত পাশেই আছে একজন দলিত, ফলে উচ্চ বর্ণের মানুষ তার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে জাত রক্ষা করতে পারত। দলিত কোথাও কোন গৃহস্থ বাড়িতে কাজে গেলে নিজেরদের মাদুরের উপর বসতো এবং গৃহস্থ বাড়ির লোকজন দলিতকে জল, চা জাতীয় কোন পানীয় দিতে চাইলে উঁচু থেকে তার ঘটির মধ্যে ঢেলে দিতো।
ভারতের সমাজ ব্যবস্থা বর্ণপ্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত যেখানে উত্তরাধিকার সূত্রে হিন্দুরা সামাজিক বিভাজন, বর্ণের বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। বর্ণপ্রথানুসারে দলিত শ্রেণি অচ্ছুৎ। ব্রাহ্মণ্যবাদ তাদের উপর আরোপ করেছে অশুচিতা, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবরোধ। তারা বংশ পরম্পরায় উচ্চ শ্রেণির হিংসার বিষবাষ্পে জর্জরিত। প্রকৃতির নিয়মে যেখানে বাধা তীব্র হয় সেখানে প্রতিরোধ হয় বেশি কিন্তু দলিত হিন্দুদের ক্ষেত্রে ঘটেছে উলটো। সামাজিক বৈষম্য তাদেরকে বানিয়ে ফেলেছে হীনমন্য, পড়ালেখার সুযোগ না পাওয়াতে তারা থেকে গেছে অশিক্ষার অন্ধকারে, ভালো কাজের সুযোগ না পেয়ে তারা দারিদ্র্যের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত। তবে যখন বুলেট যায়, দেয়ালও তখন পথ তৈরি করে দেয়। এত বাধা বিপত্তি আর যন্ত্রণা সত্ত্বেও কিছু দলিত ঠিকই পৌঁছে গেছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। যেমন ভীমরাও রামজি আম্বেদকর যিনি স্বাধীন ভারতের সংবিধান লিখেছেন। ভারতের প্রথম আইন ও বিচার মন্ত্রানালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন দলিত শ্রেণির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ১৯৫০ সালে ভারতে রাষ্ট্রীয়ভাবে দলিতদের প্রতি বৈষম্য বিলোপ করার আইন পাশ করার ক্ষেত্রে আম্বেদকরের বিশাল ভূমিকা। দলিত সম্প্রদায় থেকে ভারতের দুইজন যথাক্রমে কোচেরিল রমন নারায়নন এবং রামনাথ কোভিন্দ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও দলিত সম্প্রদায়ের অবস্থার দৃশ্যমান কোন উন্নতি হয়নি। সবচেয়ে অবাক বিষয় হলো ২০১৮ সালে ১৮ মার্চ দলিত বলে প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোভিন্দকে উড়িষ্যার একটা মন্দিরে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়। বর্ণবাদ হিন্দু সমাজের কোন স্তরে পৌঁছে গেছে প্রেসিডেন্টের ঘটনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তবে ভারতে ভোটের সময় দলিতদের কদর খুব বেড়ে যায়, কারণ সব রাজনৈতিক দলই তাদের ভোট পেতে চায়। দলিত ভোট তখন হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি। ফলে যে বর্ণ বিভাজনে দলিত শ্রেণি সাধারণ সময়ে উচ্চবর্ণের ঘৃণার শিকার তারাই আবার নির্বাচনের সময় ভোট ব্যাংকের রাজনৈতিক হাতিয়ার।
আপনার মতামত জানানঃ