দেশে মাদকদ্রব্যের সেবন ও কেনাবেচা কমছে না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নথিপত্রে দেখা গেছে, মাদকের উদ্ধার, গ্রেপ্তার ও মামলার সংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যান প্রমাণ করে দেশে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আসা রোগীর সংখ্যাও বিগত ছয় বছরের মধ্যে গত বছর সবচেয়ে বেশি ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আর সরকারের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও দেশে বাড়ছে মাদকের বিস্তার। পুলিশ, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও উদ্ধার হচ্ছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা মাদকদ্রব্য। ধরাও পড়ছে মাদক কারবারিরা। তবে আড়ালে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা। ফলে কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র বলছে বর্তমানে দেশে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের পেছনে রয়েছে মাদক। ছিনতাই, চুরি, পাড়া-মহল্লায় উঠতি বয়সী তরুণদের মধ্যে মারামারি, খুনাখুনির পেছনে রয়েছে মাদকের জের। মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ঘটছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এমনকি বেড়ে যাওয়া ধর্ষণের পেছনে রয়েছে মাদক।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও মাদক নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে দেশে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। এর তিন ভাগের দুই ভাগই তরুণ। বর্তমানে শিশু ও নারীদের মধ্যেও মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ইয়াবা মেয়েরাও অবলীলায় গ্রহণ করছে। এক সময় ফেনসিডিল, হেরোইনের মতো মাদকের বেশি চাহিদা থাকলেও, এখন তার জায়গা দখল করেছে ইয়াবা। এটি সহজেই বহন করা যায়। তাদের মতে বর্তমানে ২৪ ধরনের মাদক চলে বাংলাদেশে। আর প্রতি বছর মাদকের পেছনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। মাদকাসক্তির কারণে খুনাখুনিও হচ্ছে। মাদকের নেশায় বখে যাওয়া তরুণরা টাকার জন্য বাবা-মাকেও রক্তাক্ত করছে।
মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, টাকি, বসিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুড়িয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁ, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রাণাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদিয়া, মালদহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্তসংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুর এলাকায় মাদক ঢুকছে। আর ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেঁষা এলাকাগুলোর চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ মাদক আমদানিতে প্রতি বছর কত টাকা পাচার হচ্ছে এর সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ শতাধিক মাদকাসক্তের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে তাদের ১৫০ টাকার মাদক লাগে। এ হিসাবে একজন মাদকাসক্ত বছরে ৫৪ হাজার ৭৫০ টাকা মাদকের জন্য ব্যয় করে। এসব মাদকের পুরোটাই অবৈধভাবে দেশে আসছে। পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মাদকবিরোধী অভিযানে যারা নিহত হচ্ছে বা ধরা পড়ছে তারা খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ের। এই ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকে সেই গডফাদাররা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাদকদ্রব্যের অবৈধ অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়৷ যদি বড় ব্যবসায়ী বলা হয়, তাহলে সেরকম মাদক ব্যবসায়ী আছে পাঁচ হাজারেরও বেশি৷ তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিই আছেন৷ মাদকের ক্যারিয়ার বা খুচরা বিক্রেতা আছে কয়েক হাজার৷ কোনো কোনো মাদকসেবী আবার একই সঙ্গে খুচরা বিক্রেতা হিসেবেও কাজ করেন৷
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্ধ লেনদেন করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইয়াবা সিন্ডিকেট চক্র হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে অর্থ পাঠাচ্ছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই আসছে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, মদসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। একাধিক সূত্র, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী জানায়, মাদক আসার প্রধান উৎসই হলো হুন্ডির টাকা। এই হুন্ডির টাকা বন্ধ করা গেলেই মাদক ব্যবসা অনেকাংশে কমে যাবে।
এ দিকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকপাচার, বেচাকেনার ক্ষেত্রে নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। বাবা-মা খবর রাখছেন না তার ছেলেমেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে আর কী করছে। অনেক সময় ব্যস্ততার কারণে বাবা-মা ছেলেমেয়েদের সময় দিচ্ছেন না। এতে করে তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
মাদকসেবীদের চিকিৎসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজ করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, প্রধান তিনটি কারণে বাংলাদেশে মাদক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ ১. চাহিদার সঙ্গে পর্যাপ্ত জোগান, ২. মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত এবং কৌতূহল এবং ৩. হিরোইজম৷ মাদক সকল অপরাধের মূলে কাজ করে৷
তিনি বলেন, মাদকের চাহিদা আছে, তাই সরবরাহও আছে৷ আর এই সরবরাহ বন্ধ করতে না পারলে এর ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না৷ সরবরাহ বন্ধের দায়িত্ব সরকারের৷ সরকার তার দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করতে পারছে না বা মাদক সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে না৷ বাকি দায়িত্ব সমাজ ও পরিবারের৷ যদি সরবরাহ বন্ধ করা না যায়, তাহলে সমাজ ও পরিবার দায়িত্ব পালন করলেও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার স্বার্থেই এর চাহিদা তৈরির জন্য যা যা করা প্রয়োজন,তাই করবে৷
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৯৩৪
আপনার মতামত জানানঃ