ইউভাল নোয়াহ হারারী : একবিংশ শতকের জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে আমি আজ বক্তব্য দেবো, আর বুদাপেস্টের সেন্ট্রাল ইউরোপীয়ান ইউনিভার্সিটি এই ব্যাপারে আলাপ করার জন্য সবচে’ ভাল জায়গা। কারণ, দুর্ভাগ্যবশতঃ এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউরোপ জুড়ে শুরু হওয়া জাতীয়তাবাদী ঢেউয়ের ভুক্তভোগী হচ্ছে বা হতে চলেছে। আমার এই অঞ্চলের সাথে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্কও আছে, আমার দাদা-দাদী ছিলেন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের বাসিন্দা, তারা ৭৫ বছর আগে ইউরোপকে ধ্বংস করা জাতীয়তাবাদী সুনামিতে তাদের প্রায় গোটা পরিবারকে হারিয়েছিলেন। কিন্তু এই বক্তব্যে আমি আমার দর্শকদের, যারা নিশ্চিতভাবেই জাতীয়তাবাদের উত্থানে চিন্তিত; সাবধান করতে চেষ্টা করবো যেন তারা নিজেরাও সকল প্রকার জাতীয়তাবাদকেই মজ্জাগতভাবে ক্ষতিকর বলে ধরে নেয়ার উগ্রতা পরিহার করেন। আমি জাতীয়তাবাদের ভালো দিক- মানব ইতিহাসে জাতীয়তাবাদের অসামান্য অবদান আর একবিংশ শতকে জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলাপ করবো।
শুরুতে আমরা প্রাগৈতিহাসিককালে জাতীয়তাবাদের ইতিহাস খুঁজবো। আজকের জাতিরাষ্ট্র মানুষের জীববৈজ্ঞানিক আর মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাসের শুরুর দিক থেকে ছিল না। জাতিরাষ্ট্র মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে অত্যন্ত সাম্প্রতিক উদ্ভাবন। এটা ঠিক যে মানুষ সামাজিক জীব আর নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য আমাদের জিনে প্রোথিত আছে, কিন্তু লক্ষ বছর ধরে মানুষ ছোট ছোট দলে বাস করতো, বড় জাতিরাষ্ট্রে না। হোমো ইরেক্টাস, নিয়ান্ডারথাল আর প্রাচীন মানুষরাও ছোট দলে বাস করতো, সর্বোচ্চ একশো বা দুইশো জন সদস্যের দল।
মাত্র সত্তর হাজার বছর আগে, যেটা বিবর্তনীয় মানদণ্ডে খুব ছোট একটা কাল, হোমো সেপিয়েন্স সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে বৃহত পরিসরে পারস্পরিক সহযোগিতাকে সম্ভব করতে পেরেছে, যা প্রজাতি হিসেবে আমাদের সফলতার কারণ। এই গ্রহকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করি, নিয়ান্ডারথালরা না, বা শিম্পাঞ্জিরা না, বা হাতিরা না। কারণ আমরাই একমাত্র স্তন্যপায়ী যারা অন্য প্রাণীদের তুলনায় বেশি সংখ্যায় পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করতে পারি। আপনি যদি দশ হাজার শিম্পাঞ্জিকে একটা স্টেডিয়াম বা মার্কেটে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেড়ে দেন, ফলাফল হবে বিশৃঙ্খলা। কিন্তু দশ হাজার মানুষকে কোথাও ছেড়ে দিলে, যদি ধরে নেই যে তাদের মধ্যে সংস্কৃতির মিল আছে, তবে আপনি যা পাবেন সেটা হচ্ছে সুশৃঙ্খল সহযোগিতার নেটওয়ার্ক। কিন্তু এমন সহযোগিতার নেটওয়ার্ক তৈরি হওয়া একটি ধীর আর ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সত্তর হাজার বছর আগে যখন সেপিয়েন্সরা প্রথম গোষ্ঠী বানাতে শুরু করেছিলো তখন গোষ্ঠীগুলোর জনসংখ্যা ছিলো কয়েকশো থেকে হাজারের মধ্যে। দশ হাজার বছর আগের কৃষিবিপ্লবের পূর্বে আমরা এরচেয়ে বড় কোনো সম্প্রদায়ের কথা জানি না।
দশ হাজার বছর আগের মানুষদের এসব মানবগোষ্ঠী এখনকার জাতিরাষ্ট্রের চেয়ে অবশ্যই অনেক ভিন্ন ছিলো। জাতীয়তাবাদীরা অনেক সময় ধরে নেন রাষ্ট্র আর গোত্র একই জিনিস, কিন্তু এই দু’টো আদতে আলাদা। এসব মানবগোষ্ঠীর প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা ছিলো না, করারোপণের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না, কল্যাণ পরিষদ ছিলো না, তাদের সেনাবাহিনী বা পুলিশ ছিলো না। সবচেয়ে বড় কথা হলো এসব গোষ্ঠী ছিলো মূলত নিকট আর দূর আত্মীয়দের সংগঠন, অপরিচিত কারো স্থান হতো না এসব গোষ্ঠীতে। তিন হাজার সদস্যের একটি গোত্র ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করতো। সময়ে সময়ে শিকারে বা উৎসবে, কিম্বা শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারা এক হতো। আপনি যদি এমন গোত্রের অংশ হতেন, তবে দেখতে পেতেন মোট জনসংখ্যার ১০% হয়তো আপনার সরাসরি বন্ধু বা আত্মীয়। তারা আপনার বোন, ভাগ্নে, কাছের বন্ধু। বাকি ৯০% আপনার সাথে যুক্ত কোনো না কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর মাধ্যমে। কেউ হয়তো আপনার চাচাতো ভাই/বোনের বন্ধু, কেউ হয়তো আপনার ভাগ্নের স্ত্রীর ভাই, কেউ হয়তো আপনার সঙ্গী ছিলো পাঁচ বছর আগের কোনো উৎসবে। পুরোপুরি অপরিচিত খুব কম লোকই স্থান পেতো এসব মানবগোষ্ঠীতে। অন্যদিকে, আধুনিক রাষ্ট্রে ৯৯% লোকই একে অন্যেক চেনে না।
যেমনঃ আমার দেশ ইসরাইল, একটা ছোট দেশ, ছোট রাষ্ট্র। এর জনসংখ্যা মাত্র ৮০ লক্ষ। কিন্তু এই ৮০ লক্ষও অনেক। আমি ৮০ লক্ষের এক শতাংশ লোককেও চিনি না, ৮০ হাজার লোককেও চিনি না, এমন কি আমি ৮ হাজার লোককেও চিনি না। আমার দেশের ৯৯.৯৯% লোককে আমি চিনি না। আমি তাদের আমার ভাই বা বোন ধরে নিতে পারি, কিন্তু ব্যাপারটা শুধু কল্পনাই। আমি অধিকাংশ ইসরাইলিকে চিনি না, বা আমার বাকি জীবনে চেনার কোনো সম্ভাবনাও নেই, ব্যক্তিগতভাবে তো নয়ই। হয়তো তাদের সাথে আমার দেখা হয়েছে ট্রেন স্টেশনে, কিন্তু আমি তাদের চিনি না। তারা আমার চাচাতো ভাই/বোনের বন্ধু না, আমার ভাগ্নের স্ত্রীর ভাই না, আমার প্রাক্তন সঙ্গীও না।
আমার দেশের ভূখণ্ডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রাচীন মানবগোষ্ঠী হয়তো সর্বোচ্চ কয়েকশো বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। আপনি যদি এরকম একটি গোষ্ঠীতে থাকতেন, আপনি সেই সীমানার মধ্যে সকল পানির উৎস, প্রতিটা গাছ আর পাথর নিবিড়ভাবে চিনতেন। সে তুলনায় ইসরাইলের সীমানা হচ্ছে বিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার, হাঙ্গেরি তিরানব্বই হাজার বর্গ কিলোমিটার, রাশিয়া সতেরো মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। অধিকাংশ রাশিয়ানই রাশিয়ার অধিকাংশ জায়গায় যান নি। এমন কি ছোট্ট ইসরাইলের অধিকাংশ স্থানই অধিকাংশ ইসরাইলির জন্যে অদেখা। আমাকে যদি ইসরাইলের একটা স্থানে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ছেড়ে দেয়া হয়, নেগেভ মরুভূমি বা গ্যালিলি পর্বত বা তেল-আবিবের শহরতলিতে, আমি জানবো না আমি কোথায় আছি। আমি আমার নিজের দেশের গোটা ভূখণ্ড চিনি না।
তাই অনেকে যে আধুনিক জাতীয়তাবাদকে প্রাচীন গোত্রবাদের সমানুপাতিক মনে করেন, ব্যাপারটা ভুল। আধুনিক জাতিগুলোর চমৎকার দিক হলো, এটা মানুষকে অপরিচিত স্থানের ব্যাপারে, অপরিচিত মানুষের ব্যাপারে সহমর্মিতা শিখিয়েছে। প্রাচীন গোত্রবাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অকল্পনীয় ছিল। প্রাচীন গোত্রগুলো যখন বেশি বড় হয়ে যেত, যখন অপরিচিতের অনুপাত বেড়ে যেত, তখন এসব গোত্র ভেঙ্গে যেত। চল্লিশ বা পঞ্চাশ হাজার বছর আগে, অস্ট্রেলিয়া হয়তো একটা বা একাধিক গোত্র দ্বারা অধ্যুষিত হয়েছিল। কিন্তু যখন আঠারো শতকে ইউরোপিয়রা অস্ট্রেলিয়ায় যায়, তারা কোনো একক বা একাধিক গোত্রের দেশ পায় নি। তারা পেয়েছে শত শত আলাদা আলাদা গোত্র, যারা আবার প্রায়শই অন্যদের ব্যাপারে শত্রুভাবাপন্ন ছিলো, কারণ এসব গোত্র সময়ের সাথে সাথে অন্য গোত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো। সুতরাং এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, রাষ্ট্র গোত্র নয়, আর গোত্রবাদ জাতীয়তাবাদ নয়। কিছু জাতীয়তাবাদী এমন ভাবতে পছন্দ করেন, কারণ এতে করে জাতীয়তাবাদকে প্রাচীন আর প্রাকৃতিক একটাকিছু হিসেবে দেখানো যায়। তারা এই দু’টোর মধ্যকার পার্থক্যকে অগ্রাহ্য করার ব্যাপারে জোর দেন। কিন্তু তারা ভুল।
আমরা যদি মেনেও নেই যে জাতি আর গোত্র একই জিনিস, তবুও আমরা একে প্রাচীন আর প্রাকৃতিক প্রমাণ করতে পারি না। কারণ আমরা যেমন দেখেছি গোত্রবাদ সর্বোচ্চ ৭০ হাজার বছর পুরোনো ব্যাপার। অথচ হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির বয়স ২০ লক্ষ বছর। সুতরাং জাতীয়তাবাদ তো বটেই, গোত্রবাদও মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের সাম্প্রতিক উদ্ভাবন। কিছু জাতীয়তাবাদী বলেন জাতীয়তার আবেগ মা-সন্তানের বন্ধনের মতোই প্রাকৃতিক আর প্রাচীন। দেশকে মা হিসেবে দেখানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। “মাদার রাশিয়া” বলার পেছনের আবেগ এটাই। কিন্তু এ ব্যাপারটা আরো বেশি কষ্টকল্পিত। ব্যাপারটা পুরোপুরি উদ্ভট কল্পনা। মাতৃভূমির ধারণাও সেই ৭০ হাজার বছর পুরোনো, কিন্তু স্তন্যপায়ীদের মা-সন্তান বন্ধনের বয়স কমপক্ষে ৭০ মিলিয়ন বছর, যা মানুষের আবির্ভাবের চেয়েও বেশি পুরোনো।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমরা এতক্ষণে যা বুঝলাম তা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ ছোট ছোট গোত্রে বাস করতো, যেখানে কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার লোক একত্রে থাকতো। পাঁচ বা দশ হাজার বছর আগের কৃষিবিপ্লব, হস্তলিখন আর টাকার ব্যবহার শুরুর পরে আমরা বড় রাজ্য, সাম্রাজ্য আর দেশের উদ্ভব দেখতে পাই।
ভিন্ন গোত্রকে একটা জাতির রূপ দেয়ার ব্যাপারটা কখনোই সহজ ছিলো না, তখনো ছিলো না, এখনো সহজ নয়। কারণ আমরা দেখেছি যে গোত্র হচ্ছে পরিচিতদের একত্রে বসবাস করা, আর জাতি হচ্ছে অপরিচিতদের নিয়ে একত্রে বসবাস করা।
আবার, ‘অপরিচিত’ এবং ‘বিদেশী’র মধ্যে পার্থক্য করতে পারাটা জরুরী। বিদেশী হচ্ছে তারা যারা আমার ভাষায় কথা বলে না, দেখতে আমার মতো না, আর আমার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত না। অপরিচিত হচ্ছে তারা যারা আমার ভাষায় কথা বলে, দেখতেও আমার মতো, আর আমার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত; কিন্তু তবু সে অপরিচিতই, আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। জাতির জন্ম হয়েছে যখন কৃষি, হস্তলিখন মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছে, যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ অপরিচিত হয়েও এক সাথে থাকতে পেরেছে। তবে এই থাকতে পারা সবসময় স্বেচ্ছায় হয় নি, কখনো কখোন যুদ্ধ আর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ তবে জাতি গঠন করতে লক্ষ লক্ষ অপরিচিতকে এক সংস্কৃতি দিয়ে একত্রে রাখাটা যথেষ্ট ছিলো না। কারণ লক্ষ লক্ষ লোককে ব্যক্তিগত পরিচয় আর ঘনিষ্ঠতা ছাড়া শুধু সংস্কৃতির মিল দিয়ে একত্রিত করা সম্ভব না। কোন ভাবে তাদের মধ্যে অপরিচিতদের জন্য সহানুভূতি জাগানো প্রয়োজন, অপরিচিতদের সাথে বন্ধন তৈরি করা প্রয়োজন। জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড়ো প্রকল্প হচ্ছে অপরিচিতদের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি। এই প্রকল্পের দু’টো ভাগ আছে। প্রথম ভাগের কাজ সহজ, দ্বিতীয় ভাগের কাজ কঠিন। প্রথম সহজ কাজটা হচ্ছে বিদেশীর তুলনায় স্বজাতির লোককে বেশি পছন্দ করার প্রবণতা বাড়ানো। এটা সহজ; কারণ মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এ কাজটি করে আসছে। জেনোফোবিয়া (বিদেশীভীতি) মানুষের ডিএনএতে গাঁথা, দুর্ভাগ্যবশতঃ। যদি আমি দু’জন অপরিচিত লোকের সামনে পড়ি, যাদের আমি কখনো দেখিনি, কিন্তু তাদের একজন দেখতে আমার মতো, কথা বলে আমার ভাষায়, আমার সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত, অন্য জন দেখতে আর ভাষায় আমার চেয়ে আলাদা, আমি প্রায় সবসময়ই সেই অপরিচিতকে বেছে নেবো যে আমার মতো দেখতে, আমার ভাষায় কথা বলে। জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের সহজ ভাগ এটাই। কিন্তু জাতীয়তাবাদের দ্বিতীয় আর কঠিন ভাগটি বিদেশীদের ঘৃণা করা না। দ্বিতীয়, কঠিন আর গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে, মাঝেমধ্যে নিজের আত্মীয়ের চেয়ে অপরিচিতদের বেশি গুরুত্ব দেয়া। ধরা যাক আমি একটা সরকারী মন্ত্রণালয়ের লোক, আর আমার দপ্তরে একটা চাকরি আছে। আমি মানুষের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি, আর আমি সিদ্ধান্ত নেবো কে চাকরিটা পাবে। দুইজন চাকরি প্রত্যাশীর মধ্যে একজন যোগ্য নারী যাকে আমি কখনো দেখি নি, আরেকজন অযোগ্য কিন্তু সে আমার আত্মীয়। আমার কী করা উচিত? লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তন আমাকে বলছে, আমার আত্মীয়কে চাকরিটা দিতে; কারণটা পরিষ্কার– সে আমার আত্মীয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদ আমাকে বলছে যোগ্য অপরিচিত নারীটিকে চাকরিটা দিতে, কারণ একজন দেশপ্রেমিক নিজের পরিবারের চেয়ে জাতির স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। আর জাতির প্রয়োজন ভালো কর্মকর্তা, আমি যদি আমার আত্মীয়কে যোগ্য ব্যক্তির উপর নির্বাচিত করি তাহলে সেটা হবে দুর্নীতি আর জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
আরেকটা উদাহরণ দেই। ধরা যাক দু’টো বাচ্চা অসুস্থ। একটা বাচ্চা আমার অপরিচিত যে থাকে এমন জায়গায় যেখানে আমি কখনো যাই নি, আরেকটা বাচ্চা আমার নিজের মেয়ে। আমার মাসিক আয় ২০০০ ইউরো, এবং আমি জরুরি স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনে ১০০০ ইউরো খরচ করার সামর্থ্য রাখি। আমার কী করা উচিত? বিবর্তন আমাকে বলছে নিজের মেয়ের চিকিৎসা করাতে, তাকে সেরা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে সেরা চিকিৎসাটা দিতে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ আমাকে বলে “না! ভালো দেশপ্রেমিক নিজের পরিবারের পাশাপাশি দেশের অন্য লোকের পরিবারেরও খেয়াল রাখে। ৫০০ ইউরো দিয়ে নিজের মেয়ের চিকিৎসা করাও, আর বাকি ৫০০ ইউরো করের মাধ্যমে সরকারকে দাও যেন সে টাকা স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয় এবং এর সুফল দেশের সুবিধাবঞ্চিত অন্যরা পায়। বিবর্তন আমাকে বলে কর ফাঁকি দিতে, কিন্তু জাতীয়তাবাদ আমাকে বলে এমন কাজ দুর্নীতি, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে দেশদ্রোহ। হাজার হাজার বছর ধরে জাতীয়তাবাদ, ধর্ম এরকম ভাবাদর্শগুলো একটু হলেও স্বজনপ্রীতি বা কর ফাঁকি দেবার মত প্রবণতাগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমাদের শিখিয়েছে, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে নিজ জাতির অপরিচিত একজনের স্বার্থও নিজের আত্নীয়-বন্ধুর স্বার্থের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে।
হ্যাঁ, সত্যিই জাতীয়তাবাদ অপরিচিতদের ব্যাপারে আমাদের ভীত করে তোলে। কিন্তু এই ব্যাপারটা মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে ইতিবাচক পরিবর্তনের একটা। এটা ভেবে নেয়া একটা মারাত্মক ভুল যে, জাতীয়তাবাদ বাদ দিয়ে দিলে হয়তো আমরা একটা উদারনৈতিক স্বর্গে বাস করবো। বরং অধিক সম্ভাবনা আছে, আমরা পতিত হবো একটা গোত্রবাদী বিশৃঙ্খলায়। এ বিশৃঙ্খলায় কেউই নিজের পরিবার ছাড়া আর কারো ব্যাপারে ভাববে না, এমন অবস্থায় বড় সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, প্রতিরক্ষার মতো ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে যাবে। এমনকি গণতন্ত্রও অন্তত কিছু পরিমান জাতীয়তাবাদ ছাড়া কাজ করবে না।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষ যেটা বুঝতে চায় না সেটা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন হচ্ছে মতপার্থক্য সমাধান করার এমন একটা প্রক্রিয়া যাতে এমন কিছু মানুষ অংশ নিচ্ছে যারা অন্তত মূলনীতিগুলোতে একমত। এমন কিছু মানুষ যারা একে অন্যের ব্যাপারে সহমর্মী আর যাদের ভেতরে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও মূলনীতিতে একাত্নতা আছে। নির্বাচনের সুফল তখনই পাবেন যখন একটা দল মনে করবে- আমার বিরূদ্ধপক্ষের সবাই ভুল, এমন কি হয়ত বেকুবও, কিন্তু তাদেরকে আমি ঘৃণা করিনা এবং তারাও আমাকে ঘৃণা করেনা। যখন মানুষ একে অন্যকে ঘৃণা করে তখন সমাজ পরষ্পর সহিংস গোত্রে বিভক্ত হয়ে যায়, এভাবে গণতন্ত্র অর্জন করা যায় না। কারণ, এমন অবস্থায় প্রতিপক্ষরা যে কোনো উপায়ে জিততে চাইবে কারণ পরাজয়ের মানেই হচ্ছে তার নিজ গোত্র বিপদাপন্ন। আবার বিজয়ীরা শুধু নিজের গোত্রের কথাই ভাববে, আর যে-ই পরাজিত হবে সে-ই ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করবে, কারণ কেউই অন্য গোত্রদের ব্যাপারে সহমর্মী নয়। যদি একটা রাষ্ট্রে জাতীয়তাবোধ না থাকে সেটা হয়তো স্বৈরতন্ত্র হতে পারে, অথবা গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যেতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সেখানে চলতে পারবে না। কঙ্গো, আফগানিস্তান আর দক্ষিণ সুদানে আমরা সেটাই দেখতে পাচ্ছি।
গণতন্ত্রের জন্ম ব্রিটেন আর ডেনমার্কের মতো দেশে হওয়াটাও কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, কারণ ব্রিটেন আর ডেনমার্কে আগে থেকেই জাতীয়তাবোধ ছিল। জাতীয়তাবাদের সাহায্য ছাড়া এখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। প্রচলিত ধারণার বিপরীতে গেলেও এটা সত্যি যে, গণতন্ত্র আর জাতীয়তাবাদের মধ্যে শক্তিশালী ইতিবাচক একটা সম্পর্ক আছে। আরেকটা ব্যাপার প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, তা হলো, কিছুকিছু গণতন্ত্রের চলমান সংকটের মূল কারণ জাতীয়তাবাদের উত্থান না, বরং জাতীয়তাবাদের দুর্বল হয়ে যাওয়া। যখন জাতীয়তাবাদের শক্তি বাড়ে তখন কিছু উপসর্গ দেখা যায়, যার মধ্যে একটা হচ্ছে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘাত, যেমনটা গত শতকে ইউরোপে হয়েছে।
বর্তমানে ইউরোপে এমন সংকট প্রায় নেই বললেই চলে। বর্তমানে ইউরোপে সংকট হচ্ছে আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ, যা বরং সঠিক ধরণের জাতীয়তাবাদের অভাবের কারণে হয়। জেনোফোবিয়ার অভাব নেই, এটা সত্য, অপরিচিতদের ঘৃণা করা, বিদেশীদের ঘৃণা করা কখনোই থেমে ছিলো না। কিন্তু জাতীয়তাবাদ মানে বিদেশীদের ঘৃণা করা নয়। জাতীয়তাবাদ মানে নিজের দেশের মানুষকে ভালোবাসা। বর্তমানে বিশ্বে এমন ভালোবাসার অভাব লক্ষণীয়, ইউরোপেও একই অবস্থা। ইরাক, সিরিয়া আর ইয়েমেনে এমন ভালোবাসার অভাবে গোত্রবাদ বেড়ে জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয়ে দু’টো ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। আমেরিকায় এমন ভালোবাসার অভাবে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, আর সেখানে winner-takes-all মানসিকতা বেড়ে গেছে। আমেরিকানরা এখন রাশিয়ান, মেক্সিকান আর চায়নিজদের চেয়ে বেশি আমেরিকানদেরকেই বেশী ঘৃণা করে। যেসব নেতারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে পরিচয় দেন তারা আদতে জাতীয়তাবাদীর ঠিক বিপরীত। এরা জাতীয় ঐক্যকে শক্তিশালী না করে উস্কানিমূলক ভাষা ব্যবহার করে জাতীয় বিভেদ বাড়ায়, নিজের প্রতিপক্ষকে বিপদজনক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখায়। এটা যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের (সদ্য-সাবেক) ব্যাপারে সত্য, তেমনি ইসরাইলের ব্যাপারেও সত্য। বিশ্বের অনেক দেশেই এই পরিস্থিতি চলছে। এসব নেতারা জাতীয় সংঘর্ষকে প্রশমিত করে না, বরং সংঘর্ষকে উস্কে দেয়।
তো, আমরা দেখছি জাতীয়তাবাদ বেশ প্রয়োজনীয়, কিন্তু আবার তা একইসাথে বেশ ভঙ্গুরও। জাতীয়তাবাদ ধারণাটার এই গুরূত্ব ও এই সহজেই নড়বড়ে হয়ে যাবার বৈশিষ্ট্যটাকে একইসাথে অনুধাবন করাটা, বর্তমান ইউরোপের চলমান নানান বিতর্ক যেগুলো প্রচন্ড রূপলাভ করেছে সেগুলো বুঝবার ক্ষেত্রেও খুবই প্রাসঙ্গিক; বিশেষ করে হাঙ্গেরি আর ইউরোপের অনেক দেশে চলমান অভিবাসন বিতর্কের প্রেক্ষাপটে। জাতীয়তাবাদ একই সাথে গুরূত্বপূর্ণ আবার নড়বড়েও- এই বোধটা দুই পক্ষেরই কিছু যুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একদিকে, যারা অভিবাসন বিরোধী তারা মনে করে জাতি একটা চিরায়ত ধারণা যা আবহমান কাল ধরে একইভাবে বিদ্যমান আছে; বিদেশীদের এনে জাতিকে দুষিত করা উচিত নয়। কিন্তু এ ধারণা নিতান্তই রূপকথা, কারণ জাতি ধারণাটিই একটি সাম্প্রতিক উদ্ভাবন।
পাঁচ হাজার বছর আগে কোনো হাঙ্গেরিয়ান ছিলো না, অস্ট্রিয়ান বা ইতালিয়ান ছিলো না, ইসরাইলি ছিলো না। ইউরোপের অধিকাংশ জাতির বয়স হাজার বছরের কম, কিছু কিছুর বয়স তো আরো কম। এসব জাতি গড়ে উঠেছে অতীতে পরষ্পর শত্রুভাবাপন্ন নানান গোত্রকে, বা নৃগোষ্ঠীকে একত্রিত করার মাধ্যমে। জার্মান রাষ্ট্র বানানো হয়েছে স্যাক্সন, প্রাশিয়ান, সোওয়াবিয়ান, আর বাভারিয়ানদের সংমিশ্রনে, যারা নিকট অতীতেই একে অন্যের সাথে যুদ্ধ করতো। সতের শতকের প্রোটেস্টেন্ট প্রাশিয়ান আর ক্যাথলিক বাভারিয়ানদের মধ্যকার ‘ত্রিশ বছরের যুদ্ধ‘ বর্তমান শিয়া-সুন্নীদের বিরোধের চেয়েও বেশি সহিংস ছিলো। প্রচলিত আছে, অটো ভন বিসমার্ক, জার্মানির প্রতিষ্ঠাতা, ডারউইনের অরিজিন অফ স্পিসিস পড়ে বলেছিলেন বাভারিয়ানরা হচ্ছে অস্ট্রিয়ান আর মানুষের (প্রাশিয়ানদের) মধ্যকার মিসিং লিংক।
আধুনিক জাতীয়তাবাদ শুধু আভ্যন্তরীণ ঐক্যের মধ্যেই সীমিত না। যে দেশেই থাকুন না কেন, নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে, ভিনদেশের আবিষ্কার, পণ্য বর্জন করে চললে, আপনাদের জীবন ভীষণ একঘেয়ে আর অসম্ভব হয়ে যাবে। সারাজীবন শুধু হাঙ্গেরিয়ান খাবার খেলে আপনি জানবেন না সুশি বা তরকারি খেতে কেমন। তাছাড়া এই ‘হাঙ্গেরিয়ান খাবার’ ব্যাপারটাই বা কী জিনিস? পাপরিকা ছাড়া হাঙ্গেরিয়ান খাবার কল্পনা করা যায় না, কিন্তু পাপরিকা আদতে মেক্সিকানদের চাষকৃত মসলা ছিল, যা ষোড়শ শতকে ইউরোপে এসেছে আর পরবর্তী তিন শতকে হাঙ্গেরিয়ান খাবারে জায়গা করে নিয়েছে। আরপাড, সেইনট স্টিফেন বা ইয়ান সুনিয়াদি তাদের খাবারে এই মসলা ব্যাবহার করেন নি। তো, দেশপ্রেমিক হাঙ্গেরিয়ানদের কি পাপরিকা বর্জন করা উচিত কারণ, পাপরিকা বিদেশ থেকে আসা জিনিস যা হাঙ্গেরিকে দুষিত করে ফেলছে? ফুটবলের ব্যাপারে কী করা উচিত? ফুটবল খেলা আবিষ্কার হয়েছে ইংরেজদের দ্বারা। বিদেশি সাহিত্য? টলস্টয়, হ্যারি পটার বাদ দিয়ে শুধু হাঙ্গেরিয়ান সাহিত্য পড়তে হবে। বাইবেলও বাদ দিতে হবে, কারণ বাইবেল মধ্যপ্রাচ্যে লিখা, আর মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীরা ইউরোপে বাইবেল নিয়ে এসেছিলো! বুঝতেই পারছেন এভাবে ভাবাটা হাস্যকর।
আবার অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদের একই সাথে গুরূত্বপূর্ণ আবার নড়বড়ে হবার ব্যপারটা অতিদ্রুত অনেক বেশি অভিবাসী নেয়ার সিদ্ধান্তের পেছনের যুক্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। যারা অভিবাসনের পক্ষে, তারা গণ-অভিবাসনের ফলে হওয়া খুবই বাস্তব সমস্যাগুলো অগ্রাহ্য করেন। তারা ভুলে যান অভিবাসনের বিপক্ষে থাকা লোকেদের সাথে তাদের মতভেদ জাতীয় ঐক্যকে আর গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তারা জাতীয়তাবাদের সাথে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পর্ক আঁচ করতে পারেন না। জাতীয়তাবাদ ছাড়া গণতন্ত্র গোত্রবাদে রূপান্তরিত হবার বিপদ থেকেই যায়।
ইউরোপের অভিবাসন বিতর্কের দুই পক্ষেরই বাস্তব কিছু যুক্তি আছে। যারা অভিবাসনের পক্ষে তারা তাদের প্রতিপক্ষকে নৈতিকতাবিবর্জিত বর্ণবাদী হিসেবে দেখেন, যারা অভিবাসনের বিপক্ষে তারা প্রতিপক্ষকে দেখেন জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী হিসেবে। এই ব্যাপারটা ভালো আর খারাপের সংঘর্ষ না। বরং এটা একটা যৌক্তিক তর্ক, যার সমাধান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই হতে পারে এবং হওয়া উচিত। যে কোনো সরকার যদি অনিচ্ছুক জনগণের উপর অভিবাসী চাপিয়ে দেয় তবে সেটা ঠিক হবে না। অভিবাসন একটা দীর্ঘ, কঠিন প্রক্রিয়া; যা সফল করতে স্থানীয় জনগণের সহায়তার কোন বিকল্প নেই। আবার “জাতিগত পবিত্রতা”র মতো ভিত্তিহীন ধারণার উপর ভর করে অভিবাসী বিরোধীতাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর হবে। ইউরোপের আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা যেভাবে অভিবাসন বিরোধী উস্কানিমূলক আর ভীতির রাজনীতি করছেন এই ব্যাপারটা উদ্বেগের, আর এটি গণতন্ত্রের মূলনীতির বিরুদ্ধে।
জাতীয়তাবাদের ভালো দিক নিয়ে অনেক কথা বললাম, কিন্তু এর খারাপ দিককে এড়িয়ে গেলে ব্যাপারটা অপরাধ হবে। জাতীয়তাবাদ যখন উগ্রবাদী হয়ে যায় তখন এটা যুদ্ধ, গণহত্যা আর স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদের দিকে ঝুঁকে পরে। ফ্যাসিবাদ নিয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার, যেন আমরা বুঝতে পারি ফ্যাসিবাদ কী আর তা কিভাবে জাতীয়তাবাদের চেয়ে আলাদা। কারণ অনেকেই জাতীয়তাবাদকে ফ্যাসিবাদ ভেবে ভুল করেন, আর জাতীয়তাবাদীদের উত্থানকে ফ্যাসিবাদের উত্থান বলে থাকেন।
সংক্ষেপে বললে, জাতীয়তাবাদ আমাকে বলে, আমার জাতি অনন্য (unique), আর জাতির প্রতি আমার বিশেষ দায়বোধ থাকা উচিত। এর বিপরীতে ফ্যাসিবাদ বলে আমার জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ (supreme), আর আমার জাতির প্রতি আমার একান্ত বাধ্যবাধকতা আছে। ফ্যাসিবাদের মতে আমার জাতিই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতি, আর আমি নিজের জাতি ছাড়া অন্য কোনো জাতির প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা দেখাতে পারবো না। জাতির জন্য যদি নিজের পরিবারের বলিদান করা লাগে, আমি তাই করবো। জাতির জন্য গণহত্যা করা লাগলে, তবে তাই সই। যদি সত্য আর সুন্দরকে অগ্রাহ্য করা লাগে, আমি তাই করতে বাধ্য।
উদাহরণ হিসেবে, ফ্যাসিবাদীরা শিল্পকর্মের মূল্যায়ন কীভাবে করে? ভালো বা খারাপ সিনেমা কীভাবে নির্ধারিত হয় ফ্যাসিবাদের দ্বারা? খুব সহজ। একটামাত্র মানদণ্ড আছে- যদি জাতির স্বার্থের পক্ষে, ভাবমূর্তির পক্ষে হয়, তবে সিনেমাটা ভালো। যদি জাতির বিপক্ষে, ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর হয় তবে সিনেমাটা খারাপ। একইভাবে ইতিহাসের যেসব ঘটনা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ালে জাতির স্বার্থ আর ভাবমূর্তি রক্ষা হবে সেটাই পড়ানো হবে। এর বিপরীতে যত সত্য ইতিহাসই থাকুক, জাতির ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর হলে সেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, হলোকাস্ট আমাদের এ ধরণের ভাবনার ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। কিন্তু বর্তমানে ফ্যাসিবাদ আর অন্যান্য উগ্র-জাতীয়তাবাদ, ১৯৩০ সালের ফ্যাসিবাদ আর উগ্র-জাতীয়তাবাদের চেয়ে ভিন্ন আর বিপদজনক। কারণ এই ফ্যাসিবাদ আর উগ্র-জাতীয়তাবাদ যে শুধু যুদ্ধ আর গণহত্যার দিকেই নিয়ে যাবে আমাদের তা নয়, বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের পথেও বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড়ো তিনটি বৈশ্বিক হুমকি হচ্ছে- পারমাণবিক যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন আর প্রযুক্তিগত বিশৃঙ্খলা। এই তিনটি সংকট পৃথিবীর সকল দেশের উন্নতি আর অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ফেলে দেয়। আর এর সমাধান একা কোনো এক দেশের পক্ষে করা সম্ভব না। পতাকা উড়িয়ে আর দেয়াল বানিয়ে এর সমাধান হবে না। পারমাণবিক যুদ্ধের সময়ে দেয়াল কোনো কাজে আসবে না। দেয়াল দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন আটকাতে পারবেন না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর বায়োইঞ্জিনিয়ারিংকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যে কোন একটি দেশের পক্ষে সম্ভব না, কারণ একটি সরকার সকল বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীদের নিয়ন্ত্রণ করে না। মানুষের উপর বায়োইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উদাহরণই ধরা যাক। সকল দেশই বলবে আমরা চাই না আমাদের নাগরিকদের উপর এমন পরীক্ষা চালাতে, আমরা শুভবোধ সম্পন্ন। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ তো আর আমাদের মতো নৈতিক না, তাই আমাদের উচিত ওদের আগে এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো। অথবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন অস্ত্র বা কিলার-রোবট, বা সেনাবাহিনী। সকল দেশই বলবে এটা বিপদজনক এবং আমরা চাই না এমন প্রযুক্তি কেউ যথেচ্ছ ব্যবহার করুক। তাই আমাদের উচিত আগেভাগে এগুলো বানিয়ে বাকিদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা।
এমন প্রতিযোগিতার ফলাফলে কে জিতলো সেটা মুখ্য নয়, কারণ এতে হারবে পুরো মানবজাতি। দেয়াল দিয়ে এই পরাজয় থামানো যাবে না, প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আস্থা বাড়ানোর। ব্যাপারটা খুব কঠিন না। জার্মানি যদি ফ্রান্সকে বলে যে- আমরা কোনো পরীক্ষাগারে লুকিয়ে লুকিয়ে খুনে-রোবট বানাচ্ছি না, ফরাসিরা তাদের বিশ্বাস করবে, তাদের ইতিহাসে যতোই অবিশ্বাসের কারণ থাকুক না কেনো। মানবজাতির টিকে থাকা নিশ্চিত করতে আমাদের এমন বৈশ্বিক আস্থা তৈরী করতে হবে। ফরাসি আর জার্মানদের মতো আমেরিকান আর চায়নিজদের মধ্যেও আস্থা আনতে হবে।
একইভাবে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লব’ এর ফলে আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা সামলানোর জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লব আর স্বয়ংক্রিয় মেশিনের উদ্ভব সিলিকন ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়া আর পূর্ব চীনের হাইটেক এলাকার প্রাচুর্য প্রচুর বাড়াবে, কিন্তু একই সময়ে এর প্রভাব পড়বে সস্তা শ্রমবাজারের দেশগুলোতে। সাংহাই আর সান ফ্রান্সিসকোতে অনেক চাকরির জন্ম হবে ঠিকই, কিন্তু মেক্সিকো আর বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে চাকরির বাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে এই উন্নতি।
আমরা যদি এ সমস্যার বৈশ্বিক সমাধান না বের করতে পারি তবে নিকট ভবিষ্যতে সারা বিশ্বে নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলা এবং অভিবাসী সংকট বাড়তেই থাকবে। একবিংশ শতকে আমাদের টিকে থাকা বা সমৃদ্ধির জন্যে বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে, কিন্তু এতে জাতীয়তাবাদ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
আমেরিকার কিছু নেতা বৈশ্বিকতাবাদ আর জাতীয়তাবাদকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখিয়ে বৈশ্বিকতাবাদ নাকচ করে জাতীয়তাবাদকে বেছে নিতে বলেন, আমি সেটা জানি। কিন্তু এটাও ভুল। জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে বৈশ্বিকতাবাদ বেছে নিতে হবে বলে ভুল না, বরং এজন্য ভুল যে এই দুইয়ের মধ্যে আসলে কোনো বিরোধ নেই। কারণ জাতীয়তাবাদ মানে বিদেশীদের ঘৃণা করা না, জাতীয়তাবাদ মানে স্বজাতির প্রতি সহমর্মি হওয়া। আর একবিংশ শতাব্দীতে এসে স্বজাতির নিরাপত্তা আর সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বৈশ্বিকতাবাদ। সকল জাতীয়তাবাদীর এখন বৈশ্বিকতাবাদি হওয়া উচিত।
বৈশ্বিকতাবাদের মানে নিজের জাতির আনুগত্য আর ঐতিহ্য পরিত্যাগ করা না, বা সীমানা খুলে দিয়ে দেদারসে অভিবাসীদের ঢুকতে দেওয়া না। একটা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব প্রচলিত আছে যে ইউরোপের বৈশ্বিকতাবাদীরা চায় যেন ইউরোপ অভিবাসীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, যেন কোটি কোটি অভিবাসী বানের পানির মতো ইউরোপে ঢুকে পড়ে। এই চিন্তা পুরোপুরি অর্থহীন। আমি কিছু বৈশ্বিকতাবাদীকে চিনি, তারা কেউই এটা চান না।
বৈশ্বিকতাবাদ আসলে এরচে’ অনেক পরিমিত আর যুক্তিসংগত চিন্তা। প্রথমত, বৈশ্বিকতাবাদ মানে কিছু বৈশ্বিক নিয়মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। এসব নিয়ম জাতিগুলোর অনন্যতাকে অগ্রাহ্য করে না, মানুষের নিজের জাতির প্রতি আনুগত্যকে অস্বীকার করে না। বৈশ্বিকতাবাদ বরং রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারিত করে দেয়। ফুটবল বিশ্বকাপ এর ভালো উদাহরণ। বিশ্বকাপে অনেকগুলো জাতি অংশগ্রহণ করে, আর সেসব জাতির মানুষ নিজের জাতির জন্য ব্যাপক সমর্থন দেখায়। কিন্তু একই সময়ে বৈশ্বিক সহাবস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ বিশ্বকাপ। ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়া খেলতে গেলে আগে তাদের ফুটবল খেলার নিয়মের ব্যাপারে একমত হতে হবে। এক হাজার বছর আগে ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়া, জাপান, আর্জেন্টিনাকে এনে রাশিয়াতে ফুটবল ম্যাচ খেলানো অসম্ভব ছিল। তাদের একসাথে আনতে পারলেও তাদের খেলার নির্দিষ্ট নিয়মের ব্যাপারে একমত করানো সম্ভব হতো না। কিন্তু এখন আমরা তা-ই করি, আর এটা সম্ভব হয়েছে বৈশ্বিকতাবাদের কারণেই। আপনার যদি ফুটবল বিশ্বকাপ ভালো লাগে, তবে আপনি একজন বৈশ্বিকতাবাদি।
বৈশ্বিকতাবাদের দ্বিতীয় মূলনীতিটি হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের উপরে বিশ্বের স্বার্থকে স্থান দিতে হবে, সকল ক্ষেত্রে না, তবে কিছু ক্ষেত্রে। আবারও যদি বিশ্বকাপ ফুটবলের উদাহরণ দেই- জাতীয় দলগুলো একমত হয়েছে যে তাদের খেলোয়াড়দের দক্ষতা বাড়াতে কোনো প্রকার নিষিদ্ধ মাদক ব্যবহার করবে না। মাদক ব্যবহার করে বিশ্বকাপ জিততে পারলেও এটা করা উচিত না। কারণ অন্য দেশও তখন নিজের খেলোয়াড়দের মাদক দিয়ে তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে ফেলবে। আর তখন বিশ্বকাপ ফুটবল মূলত জৈব-রসায়নবিদদের প্রতিযোগিতায় পরিণত হবে। আর খেলার সৌন্দর্য নষ্ট হবে।
ফুটবলের ক্ষেত্রে যা সত্য, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তাই। আমাদের উচিত বৈশ্বিক স্বার্থ আর জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সাম্যাবস্থা তৈরি করা। বিশ্বায়িত পৃথিবীতেও আপনার করের টাকার সিংহভাগ শিক্ষা আর স্বাস্থ্যখাতে যাবে, এর ফল পাবে আপনার জাতির লোক। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে বা ক্ষতিকর প্রযুক্তির বিস্তার রোধ করতে জাতি তার অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত উন্নতির গতিতে ছাড় দেবে।
একথা সত্য যে অতীতে আমরা কখনোই একটা কার্যকর বৈশ্বিক সহযোগিতা প্রণয়ন করতে পারি নি। কিন্তু মানুষ নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতে পারে, জাতিও পারে। পাঁচ হাজার বছর আগে কিছু গোত্র মিলে যখন প্রথমবারের মতো জাতি গঠণ করলো, তখন তা ছিল এক নতুন উদ্ভাবন। তখনও হয়তো অনেক রক্ষণশীল লোক ছিল যারা জাতিগঠনকে অসম্ভব, অবাঞ্চিত, আর অপ্রাকৃতিক বলেছিল, বলেছিল গোত্রবাদই ভালো।
ক্ষুদ্র শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠী থেকে বৈশ্বিক সহযোগীতার দিকে দীর্ঘ যাত্রায় জাতীয়তাবাদের অবস্থান বৈশ্বিক প্রান্তের অনেক অনেক বেশী কাছাকাছি। লক্ষ লক্ষ বছরের একটা বড়ো সময় জুড়ে আমরা ৮০ জন আত্মীয়-বন্ধুর সহযোগিতা পেতে সক্ষম ছিলাম। জাতীয়তাবাদের কারণে এখন আমরা ৮০ লক্ষ, বা ৮০ কোটি লোকের সহযোগিতাও পেতে পারি। ৮০০ কোটি লোকের সহযোগিতার পথটা খুব দূরে না।
তবে, বৈশ্বিক সরকার ব্যবস্থার দাবি একটা বিপদজনক আর অবাস্তব দাবি। বরং আমার মনে হয় আমাদের লক্ষ্য হওয়া বৈচিত্র্যহীনতাকে এড়িয়ে বৈশ্বিক সম্প্রীতি। অর্কেস্ট্রার মতো, যেখানে একেকটা বাদ্যযন্ত্র একেক ধরণের সুরে বাজছে, কিন্তু একসাথে তারা দারুণ একটা সংগীতই বাজাচ্ছে। সব বাদ্যযন্ত্র যদি একই হয় তবে সংগীত হবে প্রাণহীন; আবার সব বাদ্যযন্ত্র যদি নিজের মতো করে বাজতে থাকে তবে তা হবে হট্টগোল। আমাদেরকে মাঝামাঝি একটা সাম্যাবস্থা খুঁজে নিতে হবে।
উপসংহারে বলি, আমার মূল বার্তা ছিল- আমাদের জাতীয়তাবাদ আর বৈশ্বিকতাবাদের মধ্যে যেকোন একটা বেছে নেয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, কারণ এ দুটো সাংঘর্ষিক নয়। আত্নবিশ্বাসী জাতি ছাড়া মানবসমাজ যুধ্যমান গোত্রে ভেঙে যাবে, বৈশ্বিক সহায়তা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে। আবার বৈশ্বিক সহযোগিতা ছাড়া একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ কোনো জাতির পক্ষে একা মোকাবেলা করাও সম্ভব নয়।
এর মানে কী? এর মানে হচ্ছে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করতে হবে আমাদের জাতিরাষ্ট্রের বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে থেকেই। পরবর্তী নির্বাচনে যখন কোনো প্রার্থী ভোট চাইতে আসবে তাকে চারটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করুন।
- আপনি জিতলে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি কমাতে আপনি কী পদক্ষেপ নেবেন?
- জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে আপনি কী পদক্ষেপ নেবেন?
- প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে আসা অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবেলা করতে আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর বায়োইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ঝুঁকি কমাতে আপনি কী পদক্ষেপ নেবেন?
- ২০৫০ সালের পৃথিবী কেমন হবে বলে আপনার ধারণা? সবচেয়ে নেতিবাচক ধারণাটা কী আর আপনি সেটার বিরুদ্ধে কী করবেন? সবচেয়ে ইতিবাচক ধারণাটা কী?
কেউ যদি প্রশ্ন না বোঝে, বা ক্রমাগত অতীতের কথা বলতে থাকে ভবিষ্যতের কোনো অর্থবহ পরিকল্পনা না দেখাতে পারে, তাদের ভোট দেবেন না।
ধন্যবাদ।
[বক্তব্যটির ভাষান্তর করেছেন: শোভন রেজা, গবেষণা সহকারী, BRI]
আপনার মতামত জানানঃ