রাশিয়ানরা হয়তো সামরিক শক্তির জোরে ইউক্রেন জয় করে ফেলবে। কিন্তু ইউক্রেনিয়ান জনতা বিগত কয়েক দিনে দেখিয়ে দিয়েছে, তারা ইউক্রেনকে রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেবে না।
যুদ্ধ শুরু হয়েছে এক সপ্তাহও পার হয়নি। কিন্তু এরইমধ্যে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে ভ্লাদিমির পুতিন এক ঐতিহাসিক পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে সবক’টা লড়াইয়ে জিতে গেলেও মোটের ওপর যুদ্ধে পরাজিত হবে। পুতিন বরাবরই রাশিয়ান সাম্রাজ্য পুনরায় নির্মাণ করার স্বপ্ন দেখে আসছে। তার এই স্বপ্নের বুনিয়াদ রয়েছে একটি মিথ্যার ওপর- ইউক্রেন কোনো প্রকৃত দেশ নয়, ইউক্রেনিয়ানরা আসল মানুষ নয় এবং কিয়েভ, খারকিভ এবং লভিভের বাসিন্দারা মস্কো দ্বারা শাসিত হওয়ার জন্য আকুল হয়ে রয়েছে! অথচ এটা ডাহা মিথ্যা কথা। ইউক্রেন একটি দেশ, যার কিনা এক হাজারেরও বেশি বছরের ইতিহাস রয়েছে। মস্কো তখন একটি গ্রাম হিসেবেও গড়ে ওঠেনি, অথচ সেই সময় কিয়েভ ইতোমধ্যে একটি প্রধান মহানগর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাশিয়ান স্বৈরশাসক ভ্লাদিমির পুতিন এই মিথ্যে কথা এতবার উচ্চারণ করেছে যে সম্ভবত এখন নিজেই মিথ্যেটাকে সত্য ভেবে বিশ্বাস করে বসে আছে!
ইউক্রেনে হামলা পরিকল্পনা করার সময় পুতিন বেশ কয়েকটি বিষয় হিসেব করে নিয়েছে। সে জানতো রাশিয়ান মিলিটারি ইউক্রেনের মিলিটারির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী, জানতো ন্যাটো ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য সৈন্য পাঠাবে না। সে এটাও জানতো ইউরোপিয়ান দেশগুলো রাশিয়ার ওপর তেল এবং গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, তাই জার্মানির মতো দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে ইতস্তত করবে। এই বিষয়গুলো জানা থাকায় পুতিন ইউক্রেনে দ্রুত এবং কঠোর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে। তার লক্ষ্য হলো- হামলার মাধ্যমে ইউক্রেনের বর্তমান সরকারকে উৎখাত করা এবং কিয়েভে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো থেকে বেরিয়ে আসা।
কিন্তু এখানে একটি বিরাট অজানা ব্যাপার রয়ে গেছে। যেটা আমেরিকানরা ইরাকে গিয়ে শিখেছিল আর সোভিয়েতরা শিখেছিল আফগানিস্তানে গিয়ে। সেটা হলো- একটি দেশ দখল করা সহজ কিন্তু দখলদারিত্ব ধরে রাখা অনেক কঠিন। পুতিন জানতো ইউক্রেন দখল করার মতো শক্তি তার আছে। কিন্তু ইউক্রেনিয়ান জনতা কি মস্কোর পুতুল সরকারকে সহজেই মেনে নেবে? পুতিন ভেবেছিল, মেনে নেবে। কারণ সে বারবার এটা বিভিন্ন জনকে বলেছে, ইউক্রেন কোনো প্রকৃত দেশ নয় এবং ইউক্রেনিয়ানরা প্রকৃত মানুষ নয়। ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া’র জনতা রাশিয়ান হামলাকারীদেরকে তেমন কোনো বাধা দেয়নি। তাহলে ২০২২ সালেও তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
প্রতিটি দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে পুতিনের ধারণা ভুল ছিল। সে যে বাজি ধরেছিল, সেটা ব্যর্থ হচ্ছে। ইউক্রেনের জনতা জান-প্রাণ দিয়ে প্রতিরোধ করে তুলছে, পুরো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছ থেকে বাহবা পাচ্ছে এবং যুদ্ধে জিতে যাচ্ছে। হয়তো সামনে অনেক খারাপ দিন অপেক্ষা করছে। হয়তো রাশিয়ানরা পুরো ইউক্রেন দখল করে নেবে। কিন্তু এই যুদ্ধে জিততে হলে রাশিয়াকে ইউক্রেনের দখলদারিত্বে অটল থাকতে হবে, আর তারা তখনই সেটা পারবে যখন ইউক্রেনিয়ান জনতা তাদেরকে মেনে নেবে। তবে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সেরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
একটি রাশিয়ান ট্যাংক ধ্বংস হলে, একজন রাশিয়ান সৈন্য মারা গেলে তা ইউক্রেনিয়ানদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহস আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়ানদের হামলার কারণে মৃত্যুবরণ করে নেওয়া প্রতিজন ইউক্রেনিয়ানের জন্য ইউক্রেনবাসীদের মনে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার জন্ম দিচ্ছে। ঘৃণাকে বলা হয় সবচেয়ে কৃৎসিত আবেগ। কিন্তু নির্যাতিত জাতিদের কাছে ঘৃণা গুপ্তধনের মতো মূল্যবান। হৃদয়ের গভীরে তা সংরক্ষিত থাকে এবং কয়েক প্রজন্ম ব্যাপী সেই ঘৃণা জিইয়ে রাখা যায়। রাশিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুতিনকে রক্তপাত না করে বিজয়ী হতে হবে। এতে ইউক্রেন দখল করে নেওয়ার পরেও ইউক্রেনিয়ান জনতার মনে তুলনামূলক কম ঘৃণার জন্ম হবে। কিন্তু ইউক্রেনিয়ানদের রক্ত ঝরিয়ে পুতিন মূলত নিজেই নিজের স্বপ্নের কবর রচনা করছে। রাশিয়ান সাম্রাজ্যের ডেথ সার্টিফিকেটে মিখাইল গর্বাচেভ নয় বরং পুতিনের নাম লেখা থাকবে। গর্বাচেভ রাশিয়া আর ইউক্রেনকে অনেকটা একই মায়ের পেটের সন্তানের মতো অবস্থায় রেখে গিয়েছেন। কিন্তু পুতিন এখন তাদেরকে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এবং এমন কাজ করেছে যেন ইউক্রেনিয়ান জাতি এখন থেকে রাশিয়ার বিপক্ষে দাঁড়ায়।
বিভিন্ন জাতি মূলত গল্পের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। যত দিন যাচ্ছে ইউক্রেনিয়ানদের ঝুলিতে এসব অন্ধকার দিনের গল্প যুক্ত হচ্ছে। এই গল্পগুলো তারা সামনে তো বলবেই, সেই সাথে আগামী কয়েক দশক ব্যাপী কয়েক প্রজন্ম ধরে এই গল্পগুলো জারি থাকবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং আমেরিকাকে বলেছেন তার গোলাবারুদ প্রয়োজন, পালানোর জন্য বাহন নয়। স্নেক আইল্যান্ডের সৈনিকরা একটি রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজকে উদ্দেশ্য করে বলেছে “go fuck yourself”; বেসামরিক জনতারা রাস্তার ওপর বসে রাশিয়ান ট্যাংক আটকানোর চেষ্টা করেছে। এসব গল্প থেকেই একটি জাতি গড়ে ওঠে। দীর্ঘমেয়াদে, এই গল্পগুলো মিলিটারি ট্যাংকের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়।
অন্য আট-দশজনের মতো রাশিয়ান স্বৈরশাসক ভ্লাদিমির পুতিনেরও এসব জানা উচিত। সে ছোটবেলা থেকে লেনিনগ্রাদের অবরোধকালে জার্মানদের নৃশংসতা এবং রাশিয়ানদের বীরত্বগাঁথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছে। এখন সে নিজেও একই ধরনের গল্পের জন্ম দিচ্ছে, কিন্তু এই গল্পে সে আছে হিটলারের চরিত্রে।
ইউক্রেনিয়ানদের বীরত্বপূর্ণ গল্পগুলো শুধু ইউক্রেনিয়ানদেরই নয় বরং পুরো বিশ্বকে সমাধানের পথ খুঁজতে সহায়তা করবে। সেগুলো ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সরকারসমূহকে সাহস যোগাবে, এমনকি সাহস যোগাবে রাশিয়ায় নির্যাতিত নাগরিকদের মনেও। ইউক্রেনিয়ানরা যদি খালি হাতে একটি ট্যাংক থামানোর সাহস দেখায় তাহলে জার্মান সরকারও তাদেরকে কিছু অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল সরবরাহ করার সাহস দেখাতে পারে। আমেরিকান সরকার রাশিয়াকে সুইফট (SWIFT) থেকে বহিষ্কার করতে পারে। এই নিরর্থক যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজেদের কঠোর অবস্থান প্রদর্শন করার সাহস দেখাতে পারে রাশিয়ান নাগরিকগণ।
এভাবে আমরা সবাই সাহস দেখানোর জন্য অনুপ্রাণিত হতে পারি। সেটা হতে পারে অর্থ ডোনেশনের ক্ষেত্রে, রিফিউজদের স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে কিংবা অনলাইনে সংগ্রামের সাথে যুক্ত থেকে সাহায্য করে। ইউক্রেনের এই যুদ্ধ পুরো বিশ্বের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে। যদি স্বৈরশাসন ও আগ্রাসনকে জিততে দেওয়া হয় তাহলে আমাদের সবাইকে তার ফলাফল ভোগ করতে হবে। দর্শক হয়ে চুপচাপ দেখে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এবার বুক চিতিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।
দূর্ভাগ্যবশতঃ এই যুদ্ধটি হয়তো দীর্ঘদিন ধরে চলবে। ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেবে, যা কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ব্যাপারে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিগত কয়েকটি দিন পুরো বিশ্বের কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে ইউক্রেন সত্যিকার অর্থে একটি দেশ, ইউক্রেনিয়ানরা আসল মানুষ এবং তারা কোনোভাবেই একটি নতুন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকতে চায় না। এখন মূল প্রশ্ন হলো- এই বার্তাটি রাশিয়ার পুরু দেয়াল ভেদ করে পৌঁছুতে কত সময় লাগবে?
লেখা :
ইউভাল নোয়া হারারি
ইতিহাসবিদ এবং সেপিয়েন্স : এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ হিউম্যান কাইন্ড-এর লেখক
অনুবাদ :
সাঈম শামস্
তথ্যসূত্র :
theguardian.com
আপনার মতামত জানানঃ