আধুনিক যুদ্ধের বাস্তবতায় আকাশসীমাই হয়ে উঠেছে প্রথম ও প্রধান প্রতিরক্ষার প্রাচীর। ইসরায়েল, ভারত, চীন, এমনকি ভিয়েতনামও তাদের আকাশকে রাডার ও মিসাইল-নিয়ন্ত্রিত প্রতিরক্ষার দুর্গে রূপান্তর করেছে। অথচ কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করেও বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনো দুর্বল এবং অনুন্নত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক, বিশেষ করে যখন পাশের দেশগুলো আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের নিরাপত্তা বলয় সুদৃঢ় করছে।
সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত কিংবা ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত উত্তেজনার প্রেক্ষিতে দেখা গেছে, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হলে একটি দেশ সহজেই শত্রুর কাছে বড় ক্ষতির শিকার হতে পারে। ইসরায়েলের আয়রন ডোম বা ভারতের এস-৪০০ ট্রায়াম্প এর মতো মাল্টি-লেয়ারড প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এ ধরনের হুমকি ঠেকাতে কার্যকরভাবে সক্ষম হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে এখনো পুরনো চীনা তৈরি এফএম-৯০ মিসাইল ব্যবস্থাই একমাত্র কার্যকর অস্ত্র হিসেবে রয়েছে, যা উচ্চগতির যুদ্ধবিমান বা দূরপাল্লার মিসাইল ঠেকাতে সক্ষম নয়।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বহরে বর্তমানে আছে ৪৪টি যুদ্ধবিমান, যার বেশিরভাগই পুরনো মডেলের। মিগ-২৯ এবং এফ-৭ সিরিজের এসব বিমান স্টিলথ বা আধুনিক রাডার-অ্যাভাসিভ প্রযুক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর নয় বলেই ধরা হয়। একইভাবে, বিমান বিধ্বংসী কামান, হেলিকপ্টার এবং সাবমেরিনের ক্ষেত্রেও আধুনিকীকরণের অভাব রয়েছে। গত মাসে যুক্ত হওয়া ফ্রান্সের তৈরি ‘জিএম ৪০৩ এম’ রাডার কিছুটা আশার আলো দেখালেও সামগ্রিক ব্যবস্থায় এটি খুব সামান্য পরিবর্তন আনবে।
সাবেক মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবরের মতে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনো মাকড়সার জালের মতো দুর্বল। গত ১৬ বছরে বাহিনীর চাকচিক্যের উন্নয়নে যতটা নজর দেওয়া হয়েছে, আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ততটাই উপেক্ষা করা হয়েছে। তাঁর মতে, “ডিটারেন্স ছাড়া কূটনীতি শূন্য।” কোনো দেশ যদি সামরিক সক্ষমতা অর্জন না করে, তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার গুরুত্ব কমে যায়।
এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন মনে করেন, আধুনিক যুদ্ধে আকাশ প্রতিরক্ষা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, “স্কাই সুপিরিয়রিটি যার থাকবে, যুদ্ধজয়ও তার হাতেই যাবে।” তাঁর মতে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যাতে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত নজরদারি ও প্রতিরক্ষা সম্ভব হয়। উচ্চগতির যুদ্ধবিমান, দূরপাল্লার মিসাইল ঠেকাতে আমাদের ফোর্সে থাকা উচিত মাঝারি ও দীর্ঘপাল্লার সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল (SAM) ব্যবস্থা। এটি অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ হলেও প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে অপরিহার্য।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য আরেকটি দুর্বলতা হলো স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিফেন্স শিল্প না থাকা। সাবেক কর্নেল মোহাম্মদ সোহেল রানার মতে, ভারত-পাকিস্তানের মতো দেশে ইতোমধ্যে নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে উঠেছে, যা তাদের অস্ত্রসজ্জা ও যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যাপক সহায়ক হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে এখনো সেই পর্যায়ের কোনো উদ্যোগ নেই। বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপস্থিতি, গবেষণা ও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একাডেমিক সংযোগের অভাব—সব মিলিয়ে উন্নয়নের সুযোগ প্রচুর থাকলেও কাজে লাগানো হচ্ছে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে রয়েছে ৩২০টি ট্যাংক, ৪৬৪টি কামান, ৭৭টি মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, ১১৭টি নৌযান এবং মাত্র দুটি সাবমেরিন। এসব সরঞ্জাম মূলত ভূমি যুদ্ধ উপযোগী হলেও আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় সম্পূর্ণ আলাদা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির। বিশেষ করে ক্রুজ মিসাইল, হাইপারসনিক অস্ত্র বা স্টিলথ ড্রোন প্রতিহত করতে হলে দরকার মাল্টি-লেভেল মিসাইল শিল্ড, উন্নত রাডার ব্যবস্থা এবং AI-নির্ভর প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা।
আকাশ প্রতিরক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত নয়, বরং এটি কৌশলগত মনোযোগের ঘাটতিও বটে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু অগ্রগতি যেমন বায়রাখতার টিবি টু ড্রোন সংগ্রহ, নতুন রাডার সংযোজন ইত্যাদি ইতিবাচক উদ্যোগ হলেও, তা সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখনো অস্ত্র আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দিতে পারে, তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা হুমকির কারণও হতে পারে। রাখাইনে মিয়ানমারের সংঘাত, চীন-ভারতের প্রতিযোগিতা, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব—সবকিছু মিলিয়ে এখন সময় এসেছে বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষার দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে নতুনভাবে ভাবার। বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যদি আধুনিকায়ন না করা হয়, তবে ভবিষ্যতের যেকোনো হামলার সামনে বাংলাদেশ একেবারেই অরক্ষিত রয়ে যাবে।
সবশেষে বলা যায়, একটি দেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক শক্তি অনিবার্য। বিশেষ করে আকাশসীমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করাটা আজ আর বিলাসিতা নয়, বরং কৌশলগত প্রয়োজন। তাই ভবিষ্যতের সরকারগুলোর উচিত প্রতিরক্ষা খাতে বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষায় পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, প্রযুক্তির হালনাগাদ এবং গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় এটিই সময়ের দাবি।
আপনার মতামত জানানঃ