প্রশাসনের অবৈধ ড্রেজার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও থামছে না ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করলেও প্রভাবশালীদের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সঙ্গে কোনোভাবেই পেরে উঠছে না। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ। তারা বলেন, কেবল জেলা ও উপজেলা প্রশাসন নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব পর্যায়ের দায়িত্বরতরা এবং স্থানীয়ভাবে সচেতন মহল রুখে না দাঁড়ালে এ সিন্ডিকেট মোকাবিলা করা যাবে না। কেননা অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের এ ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন দেন-দরবারের মাধ্যমে।
জানা গেছে, বরিশালের বিভিন্ন ইটভাটা মালিকরা দেশের দূর-দূরান্ত থেকে লোক ভাড়া করে চরের মাটি কেটে আনছে। বিভিন্ন জেলার এসব লোকজন বাড়তি টাকার আশায় প্রশাসনের নিষেধ অমান্য করে ঝুঁকি নিয়ে মাটিকেটে সাবাড় করছে। বিভিন্ন অভিযানকালে তাদের বাধা প্রদান করলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে আভিযানিক দলের ওপর হামলাও চালায়। এতে বিভিন্ন সময় অভিযান না করেই ঘটনাস্থল থেকে আভিযানিক দলকে অনেক সময় ফিরে আসতে হয়।
এছাড়া বালু উত্তোলনকারীরা বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে রাজনৈতিক মহল বিশেষের সঙ্গে চুক্তি করে বালু উত্তোলন করে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালের কীর্তনখোলা, আড়িয়াল খাঁ, কালাবদর, গজারিয়া, সন্ধ্যা, জয়ন্তীসহ মেঘনার বিভিন্ন শাখা নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলন ও নদীর তীরবর্তী ফসলি জমির মাটি কাটায় তীব্র ভাঙনের মুখে পড়তে হচ্ছে তীরবর্তী বাসিন্দাদের।
স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, সামান্য খরচে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে তা অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। এমন লাভের কারণে বালু দস্যুরা বিশেষ কৌশলে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে।
এছাড়া বরিশাল সদর উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোর নির্বাহী অফিসার, এসি ল্যান্ড, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ টাকা জরিমানা, বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডসহ ড্রেজার, ট্রলার ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আটক করলেও থামানো যাচ্ছে না তাদের। কেননা যারা আটক হচ্ছে তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে কিংবা তাদের পরিবর্তে অপর লোকজন ভাড়া করে প্রভাবশালী মহল পূর্বের মতো কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
এদিকে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী মহারশি নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনও বন্ধ করা যাচ্ছে না। আজ শনিবার দুপুরে ভ্রাম্যমাণ আদালত নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করার দায়ে সিরাজুল ইসলাম (২৬) নামের এক বালু ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী হাকিম ও ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সেলিম রেজা এ সাজা দেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই আগের উদ্যোমে পুনরায় বালু উত্তোলন কাজে নেমে পড়ে।
তারা বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল এসবের সাথে জড়িত বলে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা বলেন, বাংলাদেশে অবৈধ বালু উত্তোলনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন রয়েছে বলে বহু অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় এর সত্যতাও রয়েছে। অবৈধভাবে উত্তোলিত বালু আবার জলাশয় অপদখলের অন্যতম পদ্ধতি। এসব বালু দিয়েই দখলের আগে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জলাশয় ভরাট করে থাকেন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ি, রাস্তা, ব্রিজসহ যেকোনো ধরনের কংক্রিট নির্মাণসংক্রান্ত অবকাঠামো সম্পূর্ণ বৈধ বালু দিয়ে করা হয়েছে বলে কেউ দাবি করতে পারবে না।
তারা বলেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলে নেতিবাচক পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানি ও বায়ুদূষণ, প্রাকৃতিক ভূচিত্র নষ্ট হওয়া ইত্যাদি। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, এসব নেতিবাচক প্রভাবের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনে সৃষ্ট বায়ুদূষণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের মধ্যে পরিবর্তন ঘটার ফলে তাদের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি তাদের খাদ্যের উৎসও ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মৎস্য প্রজনন-প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি চাষাবাদের জমিও নষ্ট হচ্ছে।
তারা জানান, বালু উত্তোলনে পানিদূষণসহ নদীগর্ভের গঠনপ্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে এবং নদী ভাঙছে। পুরো হাইড্রোলজিক্যাল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনের কাছাকাছি মাটির ক্ষয় যেমন ঘটছে, তেমনি মাটির গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া নলকূপে পানি পাওয়াও কষ্টকর হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১১০
আপনার মতামত জানানঃ