রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখলে নিতে দখলদাররা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে চলছে এই দখলযজ্ঞ। রাজধানী ঢাকার কণ্ঠহার বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ-পশ্চিমে শাখা-প্রশাখার দুই তীর আবার দখলে মেতে উঠেছে চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা।
নদীটির দক্ষিণ-পশ্চিমে শাখা-উপশাখার দুই তীর অনেকের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আর যারা দখল করছেন তারা এলাকার প্রভাবশালী। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী। তাদের ভয়ে প্রশাসনও অনেকটা তটস্থ থাকে। দখলি জমিতে গড়ে উঠেছে পার্ক, বহুতল ভবন, শিল্প কারখানা, বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দখলদারদের অত্যাচারে দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শাখা নদীটি। পুরান ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের কোলঘেঁষা বুড়িগঙ্গার এই শাখা নদী। এক সময়ের শাখা নদীতে পালতোলা নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, ইঞ্জিন বোটসহ বড় বড় নৌযান চলাচল করত। সে সময়ে খরস্রোতা বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ বহুদূর থেকে শোনা যেত। এখন দখলদারদের বদৌলতে সবই অতীত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও উচ্চ আদালতের বারবার কঠোর নির্দেশের পরও বুড়িগঙ্গার এই আদি চ্যানেলটি প্রতিনিয়তই দখল হচ্ছে। জলাধার সংরক্ষণ আইনের বিধি উপেক্ষা করে প্রায় তিন যুগ ধরে চলা দখলযজ্ঞে ইতোমধ্যেই এই আদি চ্যানেলের শাখা নদীর প্রায় ৩৫০ একর জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। এই দখল প্রক্রিয়ার কৌশল হিসেবে সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ও বালু ফেলে ভরাট করে নদীর বুক সংকুচিত করা হয়। পরে এসব জায়গায় গড়ে তোলা হয় শিল্পকারখানা, আবাসন প্রকল্প, পার্ক ও রিক্সা-ট্রাকস্ট্যান্ড। এমনকি এই দখল পোকাপোক্ত করার জন্য কৌশলে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
এর আগে নদীর বুক দখল করে বিদ্যুত উপকেন্দ্র ও নিচু করে নির্মাণ করা হয় কয়েকটি পাকা ব্রিজ। যাতে নৌযান চলতে না পারে। এরপর নদীর বুক বালু ভরাট করে দখলের মহোৎসব চলে। সেটি এখনও থেমে নেই। সেখানে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তৈরি করে সাপ্তাহিক/মাসিক হারে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে সংঘবদ্ধ চক্র। মাঝেমধ্যে জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারী সংস্থা বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল রক্ষায় নদীর দুই তীর দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। অভিযানে স্থায়ী ব্যবস্থা না নেয়ায় আবার ভূমিদস্যুদের রাহুগ্রাসে চলে যায় বুড়িগঙ্গা। এদিকে ঢাকার বুড়িগঙ্গা শাখা-প্রশাখা ও এর চারপাশ ঘিরে নৌপথ সচল করতে বাবুবাজারসহ ১৩ সেতু ভাঙ্গার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবুবাজার ব্রিজ থেকে গাবতলী পর্যন্ত রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিমের বেড়িবাঁধের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ-পশ্চিমের শাখা নদীর লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ ও মোহাম্মদপুর অংশের বিস্তীর্ণ এলাকার প্রায় ২৪ হাজার ৫শ’ কাঠা (৩৫০ একর) জমি ইতিমধ্যে বেদখল হয়ে গেছে। লালবাগ-চকবাজারের বেড়িবাঁধসংলগ্ন কামালবাগ-আলীরঘাট, শহীদনগর, আমলীগোলা, কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ ঠোঁটা থেকে বেড়িবাঁধঘেঁষা লোহারপুল, রহমতবাগ, ব্যাটারিঘাট, কুড়ারঘাট, পূর্ব রসুলপুর, নবাবগঞ্জ সেকশন, কোম্পানীঘাট পাকা ব্রিজঘেঁষা এলাকায় বালুমাটি আর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ফেলে নদী ভরাট করে দোকানপাট ও ট্রাক-লেগুনা স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। লালবাগ বড় মসজিদ ঢাল ও পূর্ব রসুলপুর ২ নম্বর গলির সংযোগস্থল হাফেজ মুসা ব্রিজ, নবাবগঞ্জ সেকশন ও কামরাঙ্গীরচর রনি মার্কেটের সংযোগস্থলে নির্মিত পাকা ব্রিজঘেঁষা বিশাল এলাকা দখল করে মার্কেট ও বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। আমলীগোলা ঢালসংলগ্ন বেড়িবাঁধঘেঁষা বুড়িগঙ্গার বুকে ময়লা-আর্বজনা ফেলে স্তূপ করে সেখানে ট্রাকস্ট্যান্ড এবং পাশেই নদীর বুকে মাটি ফেলে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে।
নদীটির দক্ষিণ-পশ্চিমে শাখা-উপশাখার দুই তীর অনেকের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আর যারা দখল করছেন তারা এলাকার প্রভাবশালী। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী। তাদের ভয়ে প্রশাসনও অনেকটা তটস্থ থাকে।
পরিকল্পিতভাবে নদীর বুক দখল করে ৫তলা পাকা দালান ও টিনশেড বাড়িঘর বানানো হয়েছে। নবাবগঞ্জ সেকশন ও কামরাঙ্গীরচর রনি মার্কেটের সংযোগস্থলের পাশে আদি চ্যানেলের বুকে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করায় পশ্চিমে নদী দখলের মহোৎসব চলছেই। বক্স কালভার্টে বর্জ্য ফেলায় দখল-দূষণে বুড়িগঙ্গা এখানে মৃতপ্রায়।
বছরের পর বছর ধরে এসব অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠলেও তা রোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো খুব একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। তাছাড়া কামরাঙ্গীরচর-হাজারীবাগের সেকশন বেড়িবাঁধসংলগ্ন শাখা নদীর দু’পাশে সেমিপাকা ঘর, দোকান, গ্যারেজ বানানো হয়েছে। এসব দোকান থেকে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক হারে নিয়মিত ভাড়া আদায় করছে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব দখল-দূষণ আর চাঁদাবাজিতে সম্পৃক্ত রয়েছে এলাকার অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। যেন বেওয়ারিশ লাশের মতো বুড়িগঙ্গার বুক বালু দিয়ে ভরাট করে রাতারাতি দখল করে নিচ্ছে চিহ্নিত দখলবাজরা। এরপর প্রশাসনের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে তারা মালিকানা কাগজপত্র বানিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করার পর তা দখলে নিয়ে পর্যায়ক্রমে বিভিন্নজনের কাছে বিক্রি করে সটকে পড়ছে।
জানা গেছে, আশির দশক থেকে বুড়িগঙ্গার বুক ভরাট করে ঘরবাড়ি নির্মাণের হিড়িক পড়ে। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন (দক্ষিণ) থেকে লালবাগ, নবাবগঞ্জ, হাজারীবাগ, মিরপুর, গাবতলী হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করায় বাঁধের ভেতরে বুড়িগঙ্গার বিশাল এলাকা পড়ে যায়। বুড়িগঙ্গায় দখলের মহোৎসব চলে জোট সরকার আমলে। তখন কিছু প্রভাবশালী বুড়িগঙ্গা দখল প্রক্রিয়া পুরোদমে শুরু করে দেয়। জোট সরকারের আমলে গাবতলী থেকে শুরু করে নবাবগঞ্জ সেকশন পর্যন্ত নদীর বুক বালি-বর্জ্য ফেলে ভরাট করে দখলে নেয় দখলবাজরা।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার দখল-দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নৌ-মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি সোয়ারিঘাট থেকে দখল-দূষণ রোধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ ও পাউবো। টানা ৩ মাস উচ্ছেদ অভিযান চললেও হঠাৎই তা থেমে যায়। এখনো নদীর বুক দখল করে গড়ে ওঠা অসংখ্য আবাসন ও শিল্পকারখানা উচ্ছেদ করা হয়নি। ওইসব জায়গা দখলমুক্ত করতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নে খসড়া মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তা ডিএনসিসিকে দিয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে বিএসআরএফ সংলাপে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে জমি অবৈধভাবে দখল করে ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ছোট বড় স্থায়ী-অস্থায়ী নানা স্থাপনা। বুড়িগঙ্গার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে অবৈধভাবে দখলকৃত সব জমি উদ্ধার করে চ্যানেলটিকে পুনঃখনন করা হবে।
এদিকে সিএস রেকর্ড অনুযায়ী বুড়িগঙ্গা নদীর আদি চ্যানেলের সীমানা নির্ধারণ করে স্থায়ী পিলার স্থাপনের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়।
পরিবেশ বাঁচাও (পবা) আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্র, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদ, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম (নাসফ), পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ, বিডি ক্লিক, পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন, জাতীয় সচেতন ফাউন্ডেশন (জাসফা), সচেতন নগরবাসী, পুষ্পসাহা পুকুর রক্ষাকারী কমিটি, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট, পরিষ্কার ঢাকা, গ্রিনফোস, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন এই মানববন্ধনের আয়োজন করে।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল রক্ষায় শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল উদ্ধার (সিএস রেকর্ড অনুযায়ী) ও খনন করতে হবে। বেপরোয়া দখল, ভরাট ও অব্যাহত আগ্রাসনের ফলে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল এখন মৃতপ্রায়। অথচ মহানগরী ঢাকার জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাইকোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও ঢাকার প্রাণস্বরূপ বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন কিছু উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে মাত্র, যা কোনো কাজে আসেনি।
তারা বলেন, ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল সংলগ্ন মো.পুর, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ, কালুনগর, ভাগলপুর, নবাবগঞ্জ, শহীদ নগর, কামালডাঙ্গা, ইসলামবাগসহ ওই এলাকার খালগুলো এখন মরতে বসেছে। ওই সব এলাকায় বর্ষার সময় সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার মুখে পড়ে। অধিক বৃষ্টিতে অনেক ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়।
বক্তারা আরও বলেন, নদী ও জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ থাকার সত্ত্বেও প্রশাসনের চোখের সামনে দখলদাররা মরিয়া হয়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের শেষ স্পন্দনটুকু কেড়ে নেওয়ার জন্য। স্থানীয় জনসাধারণ, মহানগরবাসী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞসহ সুশীল সমাজ দখলের এ নোংরা প্রতিযোগিতা বন্ধে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ দাবি জানাচ্ছে।
এ সময় আয়োজকদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে; বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল ভরাট করে নির্মাণ করা কারখানা ও বাড়িঘরের পানি বিদ্যুৎ গ্যাসসহ সকল নাগরিক সুযোগ এখনই বন্ধ করে দেওয়া এবং অনতিবিলম্বে সকল দখল ও ভরাট এবং দূষণমুক্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের সীমানা নির্ধারণ করে স্থায়ী পিলার স্থাপন করা। বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে প্রদত্ত ভূমি বরাদ্দসমূহ সরকার কর্তৃক অনতিবিলম্বে বাতিল করা। ব্যক্তি ও সংস্থার নামে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের রেকর্ডসমূহ আইন বহির্ভূত ঘোষণা করে সেগুলো বাতিল করা। চ্যানেলের ভরাট করা জায়গা খনন করে আদি চ্যানেলের গতি প্রবাহ পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৪
আপনার মতামত জানানঃ