দেশের নদীগুলো দখলে নিতে দখলদাররা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে চলছে এই দখলযজ্ঞ। নানা কৌশলে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে নদীগুলো। সারা দেশে ৬৫ হাজার ১২৭ জন অবৈধ নদী দখলদার রয়েছেন। সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করে প্রায় ১৯ হাজার ৮৭৪ জন অবৈধ নদী দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের পঞ্চদশ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমদের টেবিলে উত্থাপিত এক প্রশ্নের জবাবে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংসদকে এ তথ্য জানান।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সব জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে দেশের নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করেছে। সারা দেশে মোট ৬৫ হাজার ১২৭ জন অবৈধ নদী দখলদার রয়েছে।’
তিনি জানান, দখলদারদের নাম প্রকাশ করে তাদের উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
সারা দেশে প্রায় ১৯ হাজার ৮৭৪ দখলদারকে এরই মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।
উদ্ধার করা নদ-নদী ও তীরভূমি, ফোরশোর যাতে পুনর্দখল না হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ও উপজেলা ভূমি অফিসের মাধ্যমে নিয়মিত পরিদর্শন ও নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান খালিদ মাহমুদ।
নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের নদীগুলো দখলমুক্ত করার জন্য ২০১০ সাল থেকে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী জমি থেকে এ পর্যন্ত ২১ হাজার ৪৪৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এতে ৭২৩ দশমিক ৬২ একর জমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা নদী বন্দরে ১৬ হাজার ৪২৪টি, নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরে ৪ হাজার ৭৬৯টি, বরিশাল নদী বন্দরে ১৪১টি, আশুগঞ্জে ৫০টি এবং নওয়াপাড়া নদী বন্দর থেকে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।
নদী দখল ঠেকাতে সারা দেশে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম চলছে বলেও সংসদকে জানান প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘নৌপথে নির্বিঘ্নে যান চলাচলে নদীপথের নাব্যতা বাড়াতে ছোট-বড় নদীগুলো খনন করার জন্য সরকার একটি ড্রেজিং মাস্টার প্ল্যান গ্রহণ করেছে। এই মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী, ১৭৮টি নদী খনন করে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ নাব্য করবে বিআইডব্লিউটিএ।’
মগড়া, নতুন, কংস, ফুলতলা, চলতি, দুধকুমার, বিজয়, বুড়ি, তুলাই, ধলা, ঘোড়া উৎরা, আত্রাই, তিতাস নদী ও আড়িয়াল খাঁ নদের মতো মৃতপ্রায় ১৫টি নদীর নাব্য পুনরুদ্ধারে ড্রেজিং চলছে বলেও জানান খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
এর আগে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চলতি বছরের শুরুতে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানায়, সারাদেশে উচ্ছেদ অভিযান চলমান থাকা সত্বেও গত এক বছরে নতুন নদী দখলদার বেড়েছে ৫ হাজার ৮৫৯ জন। ২০১৯ সালে নদী দখলদারের মোট সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৩৯০ জন। ২০২০ সালে বেড়ে এ সংখ্যা ৬৩ হাজার ২৪৯ জন হয়েছে।
সারা দেশে ৬৫ হাজার ১২৭ জন অবৈধ নদী দখলদার রয়েছেন। সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করে প্রায় ১৯ হাজার ৮৭৪ জন অবৈধ নদী দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোয় নদীর অবৈধ দখলদারের সংখ্যা আট হাজার ৮৯০ জন। এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে এক হাজার ৪৫২ জন। এসব জেলায় দখলদারের ৫০ শতাংশ উচ্ছেদ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোয় নদী দখলদার ৪ হাজার ৭০৪ জন। এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ২৩০ জন। খুলনা বিভাগে ১১ হাজার ২৪৫জন নদী দখলদার রয়েছেন। এর মধ্যে চার হাজার ৮৯০জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বরিশাল বিভাগের পাঁচ হাজার ৬১১ জন দখলদারের মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৭৯৩ জনকে। সিলেট বিভাগের দুই হাজার ৪৪ জন নদী দখলদার রয়েছেন। তাদের মধ্যে উচ্ছেদ হয়েছে ৫৭৬ জন। ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোয় চার হাজার ৮৪৮ জন দখলদারের মধ্যে এক হাজার ৭০৭ জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। রংপুর বিভাগের নদীগুলোতে দুই হাজার ৭৬০ জন দখলদার রয়েছে। এর মধ্যে ৮১৩ জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের দুই হাজার ৬৯৩ জন দখলদারের উচ্ছেদ করা হয়েছে ৪১ জনকে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীগুলোর অনেক জায়গায় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলের চিত্র দেখা গেছে। সরকারের নদী রক্ষার চার হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্প শুরু হয়েছে, তা বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দিয়েছে। কারণ সেখানে বিদ্যুৎ ও সোলার প্লান্ট, সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অনেক শিল্প কারখানা রয়েছে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেছে। তবুও এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে উচ্ছেদ কার্যক্রমে সরকারি সংস্থাগুলোর কাঙ্খিত সহযোগিতা না করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, প্রতিটি বিভাগেই পেশিশক্তি ও প্রভাব বিস্তার করে নদীর পাড়ে বা মধ্যে বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করেছে। বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও ওইসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা যায়নি। এমনকি সরকারি স্থাপনাও সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং লজিস্টিক ও অর্থ সংকটের কারণে নদী দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। ২০১৯ সালে উচ্ছেদ অভিযানে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দপ্তর, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রত্যাশা বা আশানুরূপ ছিল না। তবে আগের তুলনায় অগ্রগতি হয়েছে। উচ্ছেদ কার্যক্রমে অপ্রতুল অর্থায়ন করা হয়েছে। উচ্ছেদের ক্ষেত্রে অর্থায়নে চরম গুরুত্বহীনতা ও অবহেলা লক্ষণীয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে শিল্পায়ন হচ্ছে, রপ্তানি বাড়ছে, উন্নয়ন হচ্ছে, বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। তবে নদী না বাঁচলে এইসব উন্নয়ন কাজে আসবে না।
তারা মনে করেন, দখলদাররা যা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি দখল করে নিচ্ছে। নদী রক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা করলে টেকসই হবে। নদী দখলের সাথে প্রভাবশালীরা বেশি জড়িত বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, নদী দখলের সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করলেও বাস্তবে দেখা গেছে নদী দখলের সাথে বড় অংশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই জড়িত। নদী দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা কমিটির স্বচ্ছতা নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন।
তারা মনে করেন, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সাথে উচ্ছেদ অভিযানকারীদের আতাতের কারণে উচ্ছেদ অভিযান সুষ্ঠুভাবে সম্ভব হচ্ছে না। দিনদিন নদী দখল বাড়তে থাকায় আশঙ্কা প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশ থেকে নদী বিলীন হয়ে যেতে আর বেশিদিন নেই। ইতোমধ্যে ঢাকার নালা খাল বিলের অস্তিত্ব শূন্যে মিলিয়ে গেছে। এবার গলা টিপে ধরেছে নদীর। নদী বিলুপ্ত হয়ে গেলে দেশের অন্যান্য উন্নোয়ন কোনো কাজে আসবে না বলে হতাশা প্রকাশ করেন তারা।
তারা মনে করেন, নদী দখলদার উচ্ছেদে কার্যকরী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নদী রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলেই জীবন রক্ষা পাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৮
আপনার মতামত জানানঃ