Bálint Magyar : বর্তমানে যে হাঙ্গেরিতে আমরা বসবাস করছি তা আসলে একটি কমিউনিজম-উত্তর মাফিয়া রাষ্ট্র। একদলীয় স্বৈরতন্ত্র ও একচেটিয়া রাষ্ট্রীয় মালিকানার পতনের মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থার জন্ম। ২০১০ সালের পরে হাঙ্গেরিতে যে ধরণের শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ইউরোপে তার আর কোন দৃষ্টান্ত নেই, কিন্তু প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে যেসব রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে তার অনেকগুলোর সাথে এর তুলনা করা যেতে পারে যেমন: রাশিয়া, আজারবাইজান, কাজাখাস্তান। এছাড়াও তুলনা করা যেতে পারে বলকান অঞ্চলের দেশ মেসিডোনিয়া আর মন্টিনিগ্রোর সাথে। কিন্তু এ ব্যবস্থাটির রাজনৈতিক বিকাশ ঘটেছে একটু ভিন্ন পথে। আমরা যখন হাঙ্গেরির শাসন ব্যবস্থার কথা আলোচনা করছি তখন তাকে গণতন্ত্রের কোন একটি বিকৃত বা খন্ডিত ধরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না, কারণ সেক্ষেত্রে বিকৃত বা খন্ডিত হলেও সেটাকে গণতন্ত্রই বলতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের শাসন ব্যবস্থাকে যেভাবে গণতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের স্কেলে মাপা হয়, হাঙ্গেরিকে সেভাবে মাপা যাবে না, কারণ হাঙ্গেরির ধরণটা এই কাঠামোর সাথে কোনভাবেই মিলবে না। একই ভাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেভাবে দুর্নীতির রেংকিং করে সেই পদ্ধতিতেও হাঙ্গেরিকে বোঝা যাবে না। হাঙ্গেরির মাফিয়া রাষ্ট্রের ধরণটি একেবারেই ভিন্নরকম। এটি একটি অর্গানাইজড আপারওয়ার্ল্ড বা সংগঠিত উপরের জগৎ। প্রচলিত তুলনামূলক পদ্ধতিতে একে বুঝতে গেলে আসল চরিত্রটাই আড়ালে থেকে যায়। এই নতুন ধরণের শাসন ব্যবস্থাকে বুঝতে হবে নতুন ধরণের তাত্ত্বিক কাঠামোর মাধ্যমে।
মাফিয়া রাষ্ট্রের এই মডেলের মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাকে তার সবকিছু সহ বুঝবার চেষ্টা করা হয়েছে, যা অন্য যে কোন ধরণের স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে একেবারে আলাদা। এই মডেলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করা ও সম্পদের বিকাশের যৌথ প্রক্রিয়াটি বুঝবার ব্যাপারে গুরুত্বআরোপ করা হয়েছে।
মাফিয়া রাষ্ট্রে অর্গানাইজড আপার ওয়ার্ল্ড বা সংগঠিত উপরের জগতের সাথে ক্রিমিনাল আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগতের সম্পর্ক পাল্টে যায়: এখানে অপরাধ জগত ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগায় না বরং বিশেষ কায়েমী স্বার্থের সাথে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা ও আইন প্রণয়নের সম্পর্ক একসূত্রে গাঁথা থাকে।
মাফিয়া রাষ্ট্রে পদ্ধতিগত ভাবে ব্যক্তি স্বার্থের উপর আক্রমণ চালানো হয় এবং জনস্বার্থকে আবার ব্যক্তিস্বার্থের অধিনস্ত করে ফেলা হয়। এমন কোন ক্ষেত্র বাকি থাকে না যেখানে ক্ষমতা ও সম্পদ পুঞ্জিভবনের তৎপরতা চলে না। মাফিয়া রাষ্ট্র হলো পরজীবি রাষ্ট্রের বেসরকারিকৃত এক রুপ।
কমিউনিজম পরবর্তী মাফিয়া রাষ্ট্রে কর্তৃত্ববাদেরও নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট থাকে যা এর আগের কোন ধরণের সাথে মিলবে না। স্বৈরতন্ত্রের অপরাপর ধরণগুলোর সাথে কিছু কিছু মিল থাকলেও সার্বিক বিচারে এর ধরণটি একেবারে আলাদা।
“মাফিয়া রাষ্ট্র” কথাটি স্রেফ আবেগের বশে ব্যবহার করা হয়নি, বরং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠির মূল চরিত্র ও এর সাংগঠিনক ধরণটি বোঝানোর জন্যই ব্যবহার করা হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী নয়া এলিটদের বৈশিষ্ট বিবেচনায় অন্যান্য কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার সাথে মাফিয়া রাষ্ট্রের পার্থক্য ব্যাপক। মাফিয়াদের ক্ষেত্রে যেমন ঘটে, মূলত ক্ষমতাসীন পরিবার ও এর সাথে বিভিন্ন ভাবে সম্পর্কিত বৃহত্তর পরিবারের সদস্যদের স্থাপিত বিভিন্ন ব্যবসার উপর ভিত্তি করে এই ব্যবস্থা গড়ে উঠে। কেন্দ্রে থাকে একটি পরিবার যার সাথে উচু-নীচু ক্রম অনুসারে আত্মীয়তা ও আনুগত্যের সূতায় বাধা থাকে অন্যান্য আরো পরিবার।
প্রচলতি অর্থ মাফিয়া হলো এমন একটি প্রাক-আধুনিক পরিবার যার পরিবার-প্রধান কোন একটি অঞ্চলে অবৈধ ক্ষমতার চর্চা করে যা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিহত করবার চেষ্টা করে। মাফিয়া হলো এমন একটি বৃহত্তর পরিবার যেখানে ” রক্তের সম্পর্কহীন আত্মীয়রা পরস্পরকে শর্তহীন সহায়তা করবার কঠোর প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ”(এরিক হবসবম)। অন্যদিকে মাফিয়া রাষ্ট্রে সংশ্লিষ্ট পরিবার প্রধান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতার চর্চা করেন।
মাফিয়া রাষ্ট্রের গডফাদারের কাছে পরিবার, ঘর, নিজস্ব তালুক আর দেশ- সব একই রকম। সব পর্যায়ে তার ক্ষমতা চর্চার ধরণ একই: পুরো জাতি তার ঘরের সদস্য। পরিস্থিতি এবং দোষগুণ বুঝে বিচার করা তার কাজ।
কমিউনিজম উত্তর শাসন ব্যবস্থার স্বরুপ বুঝবার চেষ্টা: গণতন্ত্র বাস্তবায়নের বিচ্যুতি থেকে পুরা ব্যবস্থার সমালোচনা
পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমিনিষ্ট শাসিত ব্যবস্থার পতনের পর সেসব দেশে গণতন্ত্রপ্রতিষ্ঠার ঘাটতি নিয়ে নানান রকম ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়। এসব দেশের রাজনৈতিক প্রকৃয়াকে বুঝবার জন্য সাধারণত গণতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র অক্ষে ফেলে বিচার করা হয়। ধরে নেয়া হয় এসব দেশ উদার গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছে কিন্তু এখনো পৌছুতে পারে নি, পথে কোন এক জায়গায় আটকে আছে। আদর্শ উদার গণতন্ত্রের সাথে পার্থক্যের ধরণ অনুসারে এসব দেশের শাসন ব্যবস্থাকে বিভিন্ন মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়।
বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশকের মানদন্ড অনুসারে গণতন্ত্রের কতটুকু বিচ্যুতি ঘটেছে তা পরিমাপ করা হয় এবং গণতন্ত্রের মাত্রা ভেদে বিভিন্ন ধরণের প্রত্যয় যোগ করা হয় যেমন: অনুদার, ম্যানেজড, নির্দেশিত, আধা, আংশিক- গণতন্ত্র ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন ধরণের শাসন ব্যবস্থাকে বর্ণনা করার জন্য স্বৈরতন্ত্রকে আধা-স্বৈরতন্ত্র, কোমল-কর্তৃত্ববাদ, নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ ইত্যাদি আখ্যা দেয়া হয়। তাছাড়া গণতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের স্কেলে অবস্থান ভেদে হাইব্রিড বা দোআশলা শাসন ব্যবস্থাও বলা হয়। এছাড়াও ক্ষমতাসীনদের ধরণ অনুসারেও বিভিন্ন ধরণের নামকরণ করা হয় যেমন: সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী, আধিপত্যবাদি, একদলীয় ব্যবস্থা।
উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন ধরণের সংজ্ঞায় ক্ষমতা সংহত করা ও সম্পদের পুঞ্জীভবনের বিষয়টি সরাসরি স্পষ্ট হয় না। তবে যখন ক্ষমতার অবৈধ সুবিধাভোগীদের নাম নেয়া হয় তখন পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসংহত করা ও সম্পদের পুঞ্জীভবনের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয় যেমন: ক্লায়েন্টিলিস্ট রেজিম, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষী পুজিবাদ, ইত্যাদি।
কমিউনিষ্ট উত্তর মাফিয়া রাষ্ট্রের ধারণটির মাধ্যমে শুধু যে ক্ষমতা সংহত করার কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয় তা নয়, সেই সাথে কর্তৃত্ববাদী এলিটদের ধরণ নিয়েও আলোচনা করা হয়।
স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি প্রকারভেদ হিসেব মাফিয়া রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য:
কমিউনিজম-উত্তর মাফিয়া রাষ্ট্রকে স্রেফ উদার গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত কোন ব্যবস্থা বা অস্থায়ী কোন ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নত করা যাবে না। বরং এটা স্বৈরতন্ত্রের একটি বিশেষ সাব-টাইপ বা উপ-প্রকার। এই শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্টগুলোর সারসংক্ষেপ এরকম:
রাজনৈতিক ক্ষমতার ঘনীভবন এবং ব্যক্তিগত/পারিবারিক সম্পদের পুঞ্জীবভবন একযোগে চলে।
রাজনৈতিক এলিট ও অর্থনৈতিক এলিটের পালাবদল একটা পদ্ধতি অনুসারে ঘটতে থাকে, তবে তা গণতন্ত্র বা বাজার অর্থনীতির কলাকৌশল ব্যবহার করে ঘটে না। এই পালাবদল বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবারের অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত হয়।
জনস্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের অধীনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা দুর্ঘটনাক্রমে ঘটে না, বরং পদ্ধতিগত ভাবে ও নিরলসভাবে ঘটতে থাকে। জনস্বার্থ বিষয়ক নীতিমালার লক্ষ উদ্দেশ্য থাকে আড়ালে জবাবদিহিবিহীন।
মাফিয়াদের অবৈধ বলপ্রয়োগের জায়গা দখল করে বৈধ সরকারি/রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠাপোষকতায় বল প্রয়োগ। আর এর উদ্দেশ্য শুধু ক্ষমতা ধরে রাখা নয়, সেই সাথে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধি।
রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের বৈধ ও একচেটিয়া ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং বৃহত্তর পরিবারের মাঝে সুবিধা বন্টন করা হয়। প্রচলিত অর্থে অবৈধ ভাবে সম্পদ স্থানান্তরের তুলনায় এই দুর্নীতি ভিন্ন ধরণের।
বৃহত্তর পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতার বদৌলতে অর্জিত ব্যক্তিগত সম্পদ এবং জন/রাষ্ট্রীয়-সম্পদ এখানে একাকার হয়ে যায়। অথচ সাংবাধানিক রাজতন্ত্রে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার থাকে।
কর্তৃত্ববাদী মাফিয়া রাষ্ট্রের মূল ক্রীড়নকরা হলেন:
পলিগার্ক: এরা বৈধ রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে অবৈধ অর্থ-সম্পদ অর্জন করে- তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দৃশ্যমান কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকে গোপন;
অলিগার্ক: এরা বৈধ অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নিজেদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা গড়ে তোলে- এদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা দৃশ্যমান কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা গোপন থাকে;
দালাল: এদের রাজনীতি বা অর্থনীতি- কোন ক্ষেত্রেই কোন ক্ষমতা থাকে না। এরা বৈধ এবং অবৈধ জগতের মাঝে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পালন করে।
সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয় আনুষ্ঠানিক ও বৈধ সাংগঠিনক কাঠামোর আওতার বাইরে থেকে। এই মডেলটা কমিউনিস্ট পার্টির “পলিটব্যুরো”র মতো নয়, এর মডেলটা হলো বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবার দ্বারা চালিত “পলিপব্যুরো”।(হাঙ্গেরিতে অক্টোপাস কে “পলিপ” বলা হয়)। কিন্তু কাজের ধরণ অনুসারে পলিপব্যুরোর যে ধরণের বৈধতা থাকা প্রয়োজন, তা তার নাই। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নিজ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোন হাতিয়ার থাকে না। বরং খোদ রাজনৈতিক দলই হয়ে উঠে ক্ষমতাবান বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হাতিয়ার।
এই ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রকে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলা হয়, প্রশাসনের নেতৃত্বস্থানীয় পদগুলোতে বসানো হয় পার্টি কমিশার বা দলীয় প্রতিনিধিদেরকে যারা দলের প্রতি নয়, বরং রাজনৈতিক পরিবার প্রধানের প্রতি অনুগত থাকে। তারা আমলাতন্ত্রের বৈধ জগতে বিভিন্ন ধরণের ভূমিকা পালন করে: তাদের আনুষ্ঠানিক পদবী যাই থাকুক না কেন- দালাল, শাসক, প্রতিনিধি, সুপারভাইজর, হিসবারক্ষক ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমেই তাদের কার্যক্রমের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়।
শ্রেণী কাঠামো এবং ব্যক্তিগত মর্যাদার এর জায়গায় এক ধরণের পেট্রন-ক্লায়েন্ট বা দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবারটি গড়ে উঠে পরিবার প্রধানকে কেন্দ্র করে। এই পরিবার কর্তৃত্ববাদী কায়দায় কেন্দ্রীভূত ও উচু-নীচু ক্রম অনুসারে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ককে সম্বল করে গড়ে উঠে।
এই ধরণের আনুগত্য ভিত্তিক নির্ভরশীলতাকে ঠিক সামন্তীয় বলা যাবে না কারণ ক্ষমতার সমাজতাত্ত্বিক/বস্তুগত ধরণ এবং এর আইনি বৈধতা- এই দুটো বিষয় পরস্পরের সাথে খাপ খায় না। এই দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য তা পূরণ করা হয় রাষ্টীয় নিপীড়ন ও ভন্ডামির মাধ্যমে। মাফিয়া রাষ্ট্রকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সমাজতাত্ত্বিক ধরণ ও আইনি বৈধতার মধ্যে যে ফারাক তা পূরণ করতে হয় বিভিন্ন আধা-গণতান্ত্রিক প্রকৃয়ার মধ্যদিয়ে, নাগরিক অধিকার ও ভোটাধিকার সীমিত করণের মাধ্যমে। এই ব্যবস্থাটি উদার গণতন্ত্রও না আবার শুধু বলপ্রয়োগের উপর নির্ভরশীল কোন স্বৈরত্বন্ত্রও না।
পিরামিড স্কিম
সম্পদ কাঠামোর ব্যাপক ও আগ্রাসী রুপান্তরের ফলাফল স্বরুপ অর্থনীতির উপর ব্যাপক চাপ তৈরী হয় এবং সংকটের সময় মাফিয়া রাষ্ট্রের চেহারাটা অনেকটা তেলের আয়বিহীন তেল-স্বৈরতন্ত্রের মত দাড়ায়। বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবারের ক্ষমতা ও সম্পদ বৃদ্ধির জন্য আয়ের নতুন নতুন উৎসের প্রয়োজন হয়ে পড়ে যেমন: কর বৃদ্ধি, সামাজিক ব্যয় হৃাস, ব্যাংক ও জনসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আদায় এবং সর্বোপরি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে পাওয়া অর্থ রাজনৈতিক পরিবারের পকেটে ঢোকানো। এটা এক অর্থে অর্থনৈতিক পিরামিড স্কিম কারণ এখানে প্রতিটি জয়ের পেছনে থাকে তিনটি করে পরাজয়। দেখবার বিষয় হলো পশ্চিম ইউরোপের কর দাতারা আর কতদিন হাঙ্গেরীয় মাফিয়া বা ক্ষমতাসীন বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবারটির সমৃদ্ধির জন্য নিজেদের করের টাকা খরচ করে যেতে থাকবেন।
অর্থনৈতিক পিরামিড স্কিমের পাশাপাশি রাজনৈতিক পিরামিড স্কিমও রয়েছে, পররাষ্ট্রনীতিতে যেটাকে বলা যেতে পারে “পশ্চিমা নৌকায় বসে পূবালি বাতাসে চলা”। একদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে দেয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করা অন্যদিকে অর্থ ও বৈধতার জন্য পূবের স্বৈরাচারের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করা একসাথে চলে। আর দেশের ভেতরে তো নাগরিকদের অধিনস্থ করে রাখার শীতল গৃহযুদ্ধ চলমান।
মাফিয়ার রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদ অন্যরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে নয়, বরং এর উদ্দেশ্য নিজ জাতি থেকে সেই মানুষদেরকে বাদ দেয়া যারা বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবারেরর সদস্য নয় কিংবা যারা অধিনস্থ নয়। যেহেতু তারা পরিবার প্রধানের ঘরের লোক না, কাজেই বহিরাগত হওয়ার সব সমস্যা তাদেরকে ভোগ করতে হবে। ভিক্টর ওরবানের কাছে জাতি হলো তার বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবারের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সকল সদস্য। এই হাঙ্গেরীয় অক্টোপাস জাতীয় ও সামাজিক ন্যায় বিচারের অযুহাত দিয়ে এমন একটি সমষ্টিগত ও জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ তৈরী করেছে যা তাদের ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর যাদের ভাগে কিছু জুটছে না, সেই হতভাগাদের জন্য রয়েছে নানা বিষয়ে উচিত অনুচিত বিচার করার শান্তনা: একদিকে সত্যিকার দেশপ্রেমের উৎযাপন করা অন্যদিকে মাতৃভূমির শত্রু(“বহিরাগত”, “বিশ্বাসঘাতক”) ও পরজীবিদের(জিপসি, গৃহহীন, কর্মহীন) ঘৃণা করা। ক্ষমতাসীন ফিদেস্জ পার্টির নেতারা ইহুদি বিদ্বেষী না হলেও তারা ইহুদী বিদ্বেষ উৎসাহিত করে। তারা ব্যাংক সেক্টরকে ঘৃণা করে এই কারণে না যে এগুলো ইহুদিরা চালায়, বরং এই কারণে যে এগুলো তাদের নয়। তারা নিজেরা বর্ণবাদী নয়- কিন্তু তাদের সমর্থকরা বর্ণবাদী। কিন্তু তারা বর্ণবাদ ও ইহুদি বিদ্বেষ পোষণকরা ও প্রচার করার বৈধতা দিয়ে যে পাপ তারা করেছে তার কোন প্রায়শ্চিত্য হবে না। চরম ডানপন্থীদের কাছে পৌছানোর জন্য প্রচারণার নামে আরো চরম ডানপন্থীর জন্ম দিয়েছে এবং অনেক সময় চরম ডানপন্থীদেরকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জায়গা করে দিয়েছে। কে জানে এই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগত পিরামিড স্কিমের বিকাশ কিভাবে বন্ধ হবে এবং যখন একদিন এই পিরামিড স্কিম ধ্বসে পড়বে তখন সমাজের উপর কি ধরণের ট্রেজেডি নেমে আসবে!
অনুবাদ : কল্লোল মোস্তফা
[লেখাটি Bálint Magyar এর Post-Communist Mafia State — The Hungarian Case শীর্ষক প্রবন্ধের অনুবাদ। মূল লেখাটি ২০১৪ সালে ত্রৈমাসিক Aspen Review এর ৪র্থ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।]
আপনার মতামত জানানঃ