পাহাড়ের দিকে তাকালেই দখলদারদের মনে হয় এক ধরণের উত্তেজনা জাগে। যে উত্তেজনা থাকে রাস্তায় কুঁড়িয়ে পাওয়া জিনিসের প্রতি। দখলদারদের কাছেও পাহাড়কে মনে হয় রাস্তায় পড়ে আছে আর এখন নিয়ে যেতে পারলেই নিজের হয়ে গেলো। পাহাড়কে দখল করতে এজন্য দখলদারেরা বিভিন্ন কৌশল খাঁটায়। গাছ কেটে পাহাড় পরিষ্কার করে দখল, চাষবাষের অজুহাত দেখিয়ে দখল, সরাসরি জমিই দখল ইত্যাদি এখন পুরনো হয়ে গেছে। এখন বেছে নিয়েছে নয়া কৌশল। দিন-দুপুরে পাহাড় কাটতে ঝুঁকি বেশি বলে অভিনব এক পদ্ধতি বের করেছে দখলদাররা। প্রথমে পেট্রোল ঢেলে পাহাড়ের গাছপালা পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাগান করার কথা বলে এর পর মাটিতে আটকে থাকা পোড়া গাছের শিকড় উপড়ে ফেলছে। এমনভাবে এটি করা হচ্ছে, যাতে বৃষ্টি এলেই ন্যাড়া করা সেই পাহাড়ে নামে ধস। এর পর শ্রমিক লাগিয়ে রাতের আঁধারে সরিয়ে নেওয়া হবে মাটি। এতে বর্ষার শুরুতেই এর সুফল পায় দখলদাররা। ভয়াবহ এ ঘটনায় পাওয়া গেছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার যোগসাজশের প্রমাণও।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, চট্টগ্রামে এখন আগুন লাগিয়ে পাহাড় দখলের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আগুনে পাহাড়ের গাছ বা গুল্ম পুড়ে মাটি আলগা হয়ে যায়। এতে পাহাড় ধসেরও সুযোগ তৈরি হয়। ফলে আর পাহাড় কাটার প্রয়োজন পড়ে না। এভাবে দখলকারীদের জন্য পাহাড় দখলের কাজটিও সহজ হয়ে যায়। পরে এসব আগুনে পোড়া পাহাড় নামে-বেনামে এমনকি খতিয়ান পরিবর্তন করেও দখল করেছে দখলদাররা।
তারা বলেন, পাহাড়ের গাছে আগুন দেয়া এখন দখলের নতুন পদ্ধতি। যেহেতু দিনের বেলায় পাহাড় কাটায় ঝুঁকি আছে, সেজন্য দখলদাররা এখন আগুনকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আগুনে পাহাড়ের টিকে থাকার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। বৃষ্টি এলেই আগুন লাগানো এসব পাহাড় এমনিতেই ধসে পড়ে। তখন এ পাহাড় ধসের সুযোগ নেয় দখলদাররা। প্রশাসনের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয় এবং পরিবেশ আইনের সংশোধন না করা গেলে চট্টগ্রামে পাহাড় রক্ষা করা যাবে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চট্টগ্রামে পাহাড়ে অগ্নিকাণ্ডের এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটির আশপাশের বেশ কয়েকটি পাহাড় কয়েক দফায় আগুন লেগে পুড়ে যায়। কোনো কোনো জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের পর সেখানে পেট্রলের উপস্থিতি শনাক্ত করেছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সে সময় তারা জানান, দখলের জন্যই পাহাড়ে আগুন দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। এমনকি এ এলাকার পাহাড়ে চাষাবাদের নামে গাছের শিকড় তুলে ফেলাও হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
একই এলাকায় নীলাচল হাউজিংয়ের পাশের পাহাড়ে গত কয়েক বছরে আগুন লাগার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। একই ঘটনা ঘটেছে জঙ্গল ছলিমপুর এলাকায়ও। তবে গহিন ও দুর্গম এলাকা হওয়ায় এর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি প্রশাসন।
২০১৮ সালে লোহাগাড়া সমিতি লোহাগাড়া হাউজিংয়ের নামে কাটছিল পাহাড়। অভিযানের পর মামলা হলে লোহাগাড়া হাউজিং নাম পাল্টে হয় নীলাচল হাউজিং। প্রশাসনের সবাইকে ম্যানেজ করে গত দুই বছরে ৫০টিরও বেশি প্লট তৈরি করে তারা। খতিয়ানেও পরিবর্তন করে ফেলে তারা জমির শ্রেণি। জমির শ্রেণিতে আগে পাহাড় উল্লেখ থাকলেও নব্বই দশকের শেষদিকে খতিয়ানে জমির শ্রেণি উল্লেখ করে তারা ‘ছনখোলা’। এক পর্যায়ে মূল খতিয়ান থেকে উঠে যায় ‘ছনখোলা’ শব্দটিও। এর পর ‘টিলা’ লিখে চলতে থাকে প্লট বেচাকেনা। প্লটের পরিমাণ আরও বাড়াতেই পাশের পাহাড়ে আগুন দেওয়া হয়েছিল বলে ধারণা প্রশাসনের।
প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, মহানগরের বাইরে জেলা পর্যায়ে চন্দনাইশ, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়িসহ প্রতিটি উপজেলায়ই পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে মাটি কেটে নেয়া, দখলসহ নানা অপরাধ ঘটানো হচ্ছে। এছাড়া এসব জায়গায় ইটভাটার মাটি সংগ্রহের জন্যও বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ে আগুন দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
কারা এই আগুন লাগায় এবিষয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, আশপাশের পাহাড় যার দখলে আছে তারাই নতুন পাহাড়ে আগুন দেয়। পুরো পাহাড়ে একসঙ্গে আগুন লাগানো হয় না। পেট্রোল ঢেলে খণ্ড খণ্ডভাবে লাগানো হয় আগুন। সবজি চাষ কিংবা নতুন গাছ রোপণ করার অজুহাতে পরে তুলে ফেলা হয় পোড়া গাছের শিকড়।
এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের বক্তব্য হলো, পরিবেশ আইনে পাহাড় রক্ষণাবেক্ষণ, দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বা পাহাড় কাটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয়। আইনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না প্রশাসন। এজন্য বিদ্যমান পরিবেশ আইন সংশোধন প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আবাসিক এলাকা, ইটভাটা, কারখানা নির্মাণ ও মাটি বিক্রির জন্য এসব পাহাড় কাটা হয় বলে গবেষণায় বলা হয়। বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যক্তি, আবাসন ব্যবসায়ী, ইটভাটার মালিক, রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে পাহাড় নিধন করার অভিযোগ রয়েছে। বাদ যায়নি সরকারি সংস্থাও। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বোস্তামী সংযোগ সড়ক নির্মাণ করেছে। ওই সড়কের আশপাশে এখন ভূমি দস্যুরা পাহাড় কাটার উৎসবে মেতেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, পাহাড় কাটার কারণে ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে নগরের বিভিন্ন এলাকা। এ ছাড়া বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নিঃশেষ হচ্ছে বনাঞ্চল। একই কারণে পলি জমে নালা–নর্দমা ভরাট ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে একাধিক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। তারা মনে করেন, পাহাড় কাটা দুর্বলের কাজ নয়। যারা বড় বড় কথা বলেন, তারাই পাহাড় কাটার সঙ্গে যুক্ত। বর্তমান পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
এসডব্লিউ/বিবি/কেএইচ/১৯১৭
আপনার মতামত জানানঃ