জাপান ও ভারতের সঙ্গে গভীর সমুদ্রে কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের একটি চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে শ্রীলংকা। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছিল এই চুক্তিকে। কিন্তু এখন এক গণআন্দোলনের মুখে শ্রীলংকার নতুন প্রেসিডেন্ট যেন চীনের ইচ্ছাকেই বাস্তবায়িত করলেন। ধারণা করা হচ্ছে, ওই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পেছনে চীনের পরোক্ষ প্রভাব থাকতে পারে।
চীন পরিচালিত বিতর্কিত ৫০ কোটি ডলারের কন্টেইনার জেটির পাশেই কলম্বো বন্দরে ইস্ট কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণাধীন। এই যৌথ প্রকল্পের ৪৯ শতাংশ মালিকানা ছিল ভারত ও জাপানের। কিন্তু সম্প্রতি এ নিয়ে দেশের কট্টর জাতীয়তাবাদীদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে শ্রীলংকা সরকারকে। তারা জাতীয় সম্পদ বিদেশিদের কাছে বিক্রির বিরোধিতা করছেন।
ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, ২০১৯ সালে কলম্বো বন্দরের পূর্ব প্রান্তে একটি টার্মিনাল গড়তে ভারত ও জাপানের সঙ্গে চুক্তি হয় শ্রীলংকার। এর আওতায় টার্মিনালের ৪৯ শতাংশ মালিকানা ভারত ও জাপানের হাতে এবং বাকি ৫১ শতাংশ শ্রীলংকার হাতে থাকবে বলে ঠিক হয়েছিল। ভারতের তরফে বিনিয়োগকারী ছিল আদানি গ্রুপ।
কিন্তু বন্দরের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে সে দেশের ২৩টি শ্রমিক সংগঠন ও বিরোধী দলগুলো। ওই টার্মিনালের ১০০ শতাংশ মালিকানাই বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে রাখতে হবে বলে দাবি ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপআকসে প্রথমে জাপান-ভারতের পক্ষেই অবস্থান নেন। তিনি বলেন, সমুদ্রপথে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য কলম্বো হয়ে ভারতে পৌঁছে দেওয়া হয়। চুক্তি বাতিল হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
প্রেসিডেন্টের এমন বার্তা টলাতে পারেনি বিক্ষোভকারীদের। বরং দেশের সাধারণ মানুষও তাতে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, রাজাপাকসে সরকারের কিছু মন্ত্রী-আমলাও এই বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সরব হন। তাতেই চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয় শ্রীলংকা সরকার। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, চীনের প্রভাবে গোতাবায়া সরকার আগে থেকেই এই প্রকল্প বাতিলে ভেতরে ভেতরে আগ্রহী ছিল।
গোতাবায়া প্রশাসনের নেতৃস্থানীয়দের আন্দোলনে যোগ দেয়াটা তেমন ইঙ্গিতই বহন করে। দক্ষিণ এশিয়ার শাসকরা সাধারণত এমন বিরোধিতা পছন্দ করে না, আনুগত্য লঙ্ঘিত হলে নেতাদের বড় মূল্যই দিতে হয়। তবে রাজাপাকসে সরকার এ ঘটনায় যেমন দ্রুততার সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পথে হেঁটেছে, নিজ দলের বিরোধিতাকারীদের ক্ষেত্রে সেই অর্থে তেমন কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
শ্রীলংকার এই সিদ্ধান্তে কূটনীতিগতভাবে ভারত বড় ধাক্কা খেল বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। সে দেশের সাধারণ মানুষ আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়েছে, এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। ভারতের জন্য এটা একটা খারাপ বার্তা। তাছাড়া ভারত মহাসাগরে শ্রীলংকার এমন চীনযাত্রাও দিল্লির জন্য আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠছে। দেশটিতে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে চীন। সেখানে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, বন্দর-শহর, জাতীয় সড়ক এবং বিদ্যুৎ বণ্টন কেন্দ্র গড়তে প্রচুর অর্থ ঢেলেছে তারা।
রাজাপাকসে সরকারকে মোটা টাকার ঋণও দিয়েছে চীন। এই ঋণের পরিমাণ এতটাই যে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে তা শোধ করা কার্যত অসম্ভব। ঋণ শোধ করতে না পেরে ২০১৭ সালে সেখানকার একটি বন্দর বেজিংয়ের এক সংস্থাকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে বাধ্য হয় কলম্বো। তখন চীনকে সে দেশের জাতীয়তাবাদীদের বাধার মুখে পড়তে হয়নি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০১৯ সালে প্রাণঘাতী ইস্টার বোমা হামলা ও গত বছরে করোনাভাইরাসের লকডাউনের কারণে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যায় দেশটি। চলতি বছরে তাই চীনের কাছ থেকে আরও ঋণ প্রত্যাশা করছে তারা। এ অবস্থায় চীনের পক্ষে সে দেশে গণজোয়ার তৈরি করে ভারত ও জাপানের প্রকল্প অংশীদারিত্ব বাতিল করাটা পরিকল্পনার অংশও হতে পারে বলে ধারণা একাংশ দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞের।
হাম্বানতোতা বন্দরে চীন পা রাখায় ভারত মহাসাগরে বেইজিংয়ের সামরিক সুবিধা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উদ্বিগ্ন। ২০১৪ সালে কলোম্বো টার্মিনালে চীনা ডুবোজাহাজের অঘোষিত ভ্রমণের প্রতিবাদ জানিয়েছিল ভারত। তারপর থেকে সাবমেরিনের অনুমতি দেয়া বন্ধ রেখেছে শ্রীলংকা। কিন্তু এখন সেই শ্রীলংকাই উল্টো বার্তা দিল।
এটা দৃশ্যমান যে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে। অর্থনৈতিকভাবে তারা একে একে এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশকেই বেঁধে ফেলছে। পাশাপাশি ইদানীং রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে ড্রাগনেরা। শ্রীলংকার বর্তমান প্রেসিডেন্টের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে দেশটির সহযোগিতা ছিল বলে মনে করা হয়। নতুন প্রশাসন এখন তারই দাম চোকাতে শুরু করেছে হয়তো।
এসডব্লিউ/আরা/০১৪৫
আপনার মতামত জানানঃ