ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পালিয়ে দেশত্যাগের দেড় মাসেরও বেশি সময় পর দেশে ফিরেছেন শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। গত জুলাইয়ের দেশত্যাগের পর প্রথমে মালদ্বীপ, সেখান থেকে সিঙ্গাপুর, পরে থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি।
স্থানীয় সময় শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর) দিনগত রাত ১২টার পর সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ব্যাংকক থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে কলম্বোর অদূরে বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। এ সময় বিমানবন্দরে তার দলের আইনপ্রণেতারা তাকে স্বাগত জানান। পরে সশস্ত্র সৈন্যদের কড়া পাহারা দিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন রাজাপাকসে।
সাবেক এই রাষ্ট্রপতির ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, রাজাপাকসে কলম্বোতে একটি সরকারি বাসভবনে থাকবেন, তার জন্য ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. অরুণা কুলাতুঙ্গা বলেছেন, রাজাপাকসেও একটি সরকারি বাসস্থান পাবেন, যা তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে হস্তান্তর করা হবে।
গণবিক্ষোভের মুখে রাতের অন্ধকারে ১৩ জুলাই দেশ ছাড়ার পর সাবেক এই প্রেসিডেন্ট প্রথমে মালদ্বীপে যান। সেখান থেকে মেডিকেল ভিসায় সিঙ্গাপুর, পরে থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি।
এতদিন থাইল্যান্ডের একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন গোতাবায়া। তার সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ইয়োমা রাজাপাকসে।
প্রথমে তাদের পরিকল্পনা ছিল আগামী নভেম্বর পর্যন্ত তারা থাইল্যান্ডে থাকবেন। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে তার দেশে ফেরার খবর আসে অগাস্টের মাঝামাঝিতে।
এরমধ্যে গোয়াবায়ার যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ড পাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে গত ১৮ অগাস্ট খবর বের হয়। তার স্ত্রী একজন মার্কিন নাগরিক হওয়ায় সেখানে তাদের স্থায়ীভাবে থাকার চেষ্টার কথা খবরে আসে।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জ্বালানি ও খাদ্য ঘাটতি নিয়ে সংকটে পড়লে দেশটিতে জনবিক্ষোভ শুরু হয়। এর আগ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ছিল রাজাপাকসে সাম্রাজ্যেরই আধিপত্য।
এরপর গণবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে দেশ ছাড়তে একপ্রকার বাধ্য হন গোতাবায়া। রাতের আঁধারে বিমানবাহিনীর একটি এয়ারক্রাফটে দেশ ছাড়েন তিনি।
তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন, যাকে দেবতা বলে মনে করত দেশের মানুষ। তবে তিনি কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে অভ্যস্ত নন।
রাজাপাকসে পালিয়ে গিয়ে পদত্যাগ করার পর শ্রীলঙ্কার ছয়বারের প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে জয়ী হয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।
থাইল্যান্ডে নিরাপত্তার ঘাটতির কারণে হোটেলেই একপ্রকার বন্দি ছিলেন তিনি। সে কারণে তিনি দেশে ফিরতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে সাবেক প্রেসিডেন্টের ফেরার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেন রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন দল এসএলপিপি এর অনুরোধে।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রথমে প্রতিবেশী মালদ্বীপে গিয়েছিলেন রাজাপাকসে, একদিন পর ১৪ জুলাই সেখান থেকে সিঙ্গাপুর চলে যান তিনি। পরে সিঙ্গাপুর থেকে পাঠানো পদত্যাগপত্রে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়েন তিনি।
ওই সময় সিঙ্গাপুরের সরকার জানিয়েছিল, তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়নি, তিনি ব্যক্তিগত সফরে সেখানে গিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ফিরে আসায় দেশটিতে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় গোতাবায়ার ভবিষ্যৎ কী, তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে।
অধিকারকর্মীদের একাংশ বলছে, রাজাপাকসের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হতে পারে। তবে রাজাপাকসের মিত্ররা এখন ক্ষমতায় রয়েছেন। তাই বিশ্লেষকেরা বলছেন, তার বিচারের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা কম।
শ্রীলঙ্কায় একসময় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন গোতাবায়া। কয়েক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরাজিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন রাজাপক্ষে। তবে এই জনপ্রিয়তা শেষ পর্যন্ত টেকেনি।
শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার কমিশনের সাবেক কমিশনার ও আইনজীবী আম্বিকা সাথকুনানাথান বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত এক নেতা হিসেবে স্থায়ী বা অস্থায়ী আবাস পাওয়া রাজাপক্ষের জন্য কঠিন হবে। এটা তার কল্পনার চেয়েও বেশি কঠিন হবে।
আম্বিকা আরও বলেন, তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন, যাকে দেবতা বলে মনে করত দেশের মানুষ। তবে তিনি কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে অভ্যস্ত নন।
মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী সাথকুনানাথান বলেছেন, রাজাপাকসের ফিরে আসায় আবার বিক্ষোভ হওয়া নিয়ে ভয় রয়েছে। জীবনযাপনের খরচ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে।
সাথকুনানাথান আরও বলেন, দেশে যখন লাখ লাখ মানুষ খাবার ও জ্বালানির সংকটে রয়েছে, তখন রাজাপাকসের আয়েশি জীবনযাপনে আবারও বিক্ষোভ হতে পারে।
আইটিজেপির সুকা বলছেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নিয়ে সাবেক নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সম্ভাবনা কম। রাজনৈতিক মিত্রশক্তি তাকে সুরক্ষিত করবেন। তবে তিনি এমনও বলেছেন, নাগরিক সমাজ তার বিরুদ্ধে মামলা শুরু করতে আদালতে আবেদন করবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল ও পুলিশ এ ধরনের পদক্ষেপে সমর্থন করবে বলে আশা করা যায়। সব অভিযোগ থেকে গোতাবায়াকে অব্যাহতি দিলে তা কেউ মেনে নেবে না। গোতাবায়ার প্রতি আইনি পদক্ষেপে বিশ্ব ও শ্রীলঙ্কাবাসী বুঝতে পারবে যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৩
আপনার মতামত জানানঃ