আশরাফুল হক : দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর ব্যবহারের কারণে স্থানীয় ছয়টি এয়ারলাইনসের কাছে সরকারের পাওনা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘদিন তাগাদা দেওয়ার পরও এসব টাকা উদ্ধার করতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি)। এসব বকেয়ার ওপর চোখ পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। বিধিবদ্ধ এ সংস্থাটি বিরাট অঙ্কের টাকা বকেয়া পড়ার কারণ জানতে চেয়েছে। একই সঙ্গে বকেয়া আদায়ের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তা জানাতে বলেছে দুদক।
সিভিল এভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান গতকাল বুধবার রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন হয়তো আমাদের কোনো গাফিলতি আছে কি না তা দেখতে চাচ্ছে। এখানে কোনো দুর্নীতি হচ্ছে কি না তাও দেখতে পারে। এয়ারপোর্ট ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের চার্জ আছে। এয়ারপোর্ট ব্যবহার করলে এসব চার্জ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দিতে হয়। আমাদের সবচেয়ে বেশি পাওনা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কাছে। যদিও তারা এখন পরিশোধ শুরু করেছে। ইউএস-বাংলা ও নভোএয়ার রেগুলারলি পরিশোধ করছে। ইউনাইটেড এয়ারলাইনস বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা তাদের এয়ারক্রাফট বাজেয়াপ্ত করেছি। সেগুলো বিক্রি করে টাকা সমন্বয় করা হবে। জিএমজির কাছেও পাওনা আছে। রিজেন্ট এয়ারলাইনসও ফিরে আসছে। আমরা এসব বকেয়া আদায়ে তৎপর রয়েছি।’
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কাছে সরকারের পাওনা ৩ হাজার ৯২ কোটি ৬৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৫২ টাকা। বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে পাওনা ২০৩ কোটি টাকার ওপরে। ইউনাইটেড এয়ারলাইনসেরও আগে বন্ধ হয়ে গেছে জিএমজি এয়ারলাইনস। সংস্থাটির কাছে সরকারের পাওনা ৩৬৮ কোটি ১৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৮ টাকা। নিভু নিভু করে চলা রিজেন্ট এয়ারলাইনসের বকেয়া পড়েছে ২৪৫ কোটি টাকার বেশি। ধারাবাহিকভাবে এয়ারলাইনস ব্যবসা সম্প্রসারণকারী ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসও রয়েছে বকেয়ার খাতায়। সংস্থাটির কাছে পাওনা ৪৪ কোটি ৯৫ লাখ ১৮ হাজার ৮৫২ টাকা। নভোএয়ারের কাছে সিভিল এভিয়েশনের পাওনা ৯৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। দুদকের পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেকোনো আর্থিক লেনদেনেই স্বচ্ছতা থাকা উচিত। বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় হচ্ছে না। এ বকেয়ার কারণ জানতেই চিঠি পাঠানো হয়েছে। আর উদ্ধারে সংশ্লিষ্টরা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।’
সিভিল এভিয়েশন অথরিটি প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করে। চট্টগ্রাম বন্দরের পরপরই এ নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবস্থান। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, সিভিল এভিয়েশনের মূল আয় হচ্ছে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কাছ থেকে অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল বাবদ প্রাপ্ত অর্থ। এ উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি নিজেদের রাজস্ব ব্যয় নির্বাহ করা ছাড়াও সব বিমানবন্দর উন্নয়ন, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। অভ্যন্তরীণ এয়ারলাইনসগুলোর কাছে পাওনা বকেয়া পড়ে থাকায় সিএএবির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে।
বকেয়া অর্থ অনাদায়ী থাকার কারণে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের দপ্তর থেকে প্রতি বছর অডিট আপত্তি উত্থাপন করা হচ্ছে। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কাছে এ বকেয়া প্রশ্নে কোনো জবাব দিতে পারছে না। সিভিল এভিয়েশন আইন অনুযায়ী, এই কর্র্তৃপক্ষ আয়কর থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদের আইনে নতুন ধারা সংযোজনের মাধ্যমে সিএএবির ওপর আয়কর ধার্য করছে। এ কারণে সিভিল এভিয়েশন বকেয়া টাকা আদায়ের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে নিয়মিত চিঠি লিখে আসছে।
সিভিল এভিয়েশন অথরিটির কর্মকর্তারা জানান, ২০১৭ সালে বিমানের কাছে সংস্থাটির পাওনা ছিল প্রায় ২ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকার ওপরে। এ কয়েক বছরের ব্যবধানে বিমানের কাছে পাওনা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের কাছেই শুধু বিমানের বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া পড়েছে তা নয়, অন্যান্য সংস্থাও বিমানের কাছে টাকা পায়। পদ্মা অয়েল কোম্পানিও বিমানের কাছে বিপুল পরিমাণ টাকা পায়। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পদ্মা অয়েল কোম্পানি বিমানের কাছে ১ হাজার ৪৪৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা পায়।
বিমানের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত পদ্মা অয়েল বিমানকে ৫৭৫ কোটি টাকার জ¦ালানি তেল সরবরাহ করেছে। বিমান ৪৮৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে বিমান আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছিল। দীর্ঘদিন লন্ডন বা ম্যানচেস্টার ছাড়া অন্য সব রুটে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ছিল। এসব কারণে বিমানের রাজস্ব আয় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অব্যবহৃত টিকিটের দাম ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে বিমান। এসব কারণে বিমানের ক্যাশ ফ্লো নাজুক অবস্থায় চলে গেছে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ করে দেয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। ২০০৫ সালে সিএএবির অনুমোদন পাওয়ার পর ২০০৭ সালের ১০ জুলাই ফ্লাইট অপারেশন শুরু করেছিল এ এয়ারলাইনসটি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজের সামনে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের ১২টি পরিত্যক্ত উড়োজাহাজ। বিমানবন্দর কার্গো ভিলেজ অ্যাপ্রোনের বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে এসব উড়োজাহাজ। পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আটটি ও জিএমজির একটি, রিজেন্ট এয়ারওয়েজের দুটি ও অ্যাভিয়েনা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ। কোনো ধরনের চার্জ পরিশোধ না করেই উড়োজাহাজগুলো বছরব্যাপী বিমানবন্দর রানওয়ে এলাকায় ফেলে রাখা হয়।
সম্প্রতি ধারাবাহিকভাবে ফ্লাইট সম্প্রসারণ করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। নতুন নতুন এয়ারক্রাফট যুক্ত হচ্ছে এর বহরে। ইউএস-বাংলার জেনারেল ম্যানেজার কামরুল ইসলাম গতকাল রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা বিমানবন্দর ব্যবহারের বিভিন্ন চার্জ কমানোর একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সরকারও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসব চার্জ কমানোর। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এলে বকেয়া পরিশোধ করা হবে। তাছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী এয়ারলাইনস ব্যবসায় ধস নেমেছে। আমরাও এর বাইরে নই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেই আমরা সব দেনা শোধ করে দেব।’
আপনার মতামত জানানঃ