বিকালে সূর্য হেলে লাল হওয়ার সাথে সাথেই রাজধানীবাসী তটস্থ হয়ে ওঠে। গোটা নগরেই এক রকম হৈচৈ পড়ে যায়। বাইরে দিনের আলো ম্লান হবার সাথে সাথেই ঘরের দরজা জানালা বন্ধের এক মহা তোড়জোড় চলে নগরবাসীর। যেভাবে হানাদার বাহিনীর আতঙ্কে লোকজন ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ভেতরে ঘুপটি মেরে থাকতো, তেমনি এক হৈচৈ পড়ে যায়। না, বাহির থেকে কোনো হানাদার বাহিনী কিংবা অন্ধকার প্রবেশে বাঁধা দেওয়ার জন্য দরজা জানালা বন্ধের এই তোড়জোর চলে না। শীত এলেই নগরে মশারা মাস্তানের ভূমিকায় নেমে পড়ে। দিনের আলো মিলিয়ে যেতে দেখলেই নিজেদের হুলে ধার দিতে দিতে ঘরের দরজা জানালা খুঁজতে থাকে। আর তাদের ভয়েই নগরবাসী ঝটপট দরজা জানালা বন্ধ করার তোড়জোড় শুরু করে দেয়।
দরজা জানালা বন্ধ করা নিয়েও অনেক পরিবারে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কাজের লোকেরাও তাদের অপমানের ঝুলিতে ভরে তোলে কিছু ধিক্কার। দিনে কোনো জানালা খুলে রেখে অফিস কিংবা মার্কেটে গেলেও সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে মন পড়ে থাকে ওই জানালাতে। মনে মনে আফসোস করে কেউ, কেউবা অসহায়ের মতো বাড়ি ফেরে।
মাঝে মাঝে যদিও ভুলক্রমে কোনো জানালা খুলে রাখা হলে, তাতেই পেয়ে বসেছে যেন। ধোঁয়ার মতোই দলবল নিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে। মাঝে মাঝে দরজা জানালা সুপার গ্লু দিয়ে তন্ন তন্ন করে লাগিয়ে দিলেও কোথা থেকে যেন মশার দল ঢুকে পড়ে! আর তাদের অস্ত্রও যেমন তেমন নয়। একেকটা যেন মুখে সুই নিয়ে চলা ফেরা করে। নরম কোনো দেহ পেলেই সিরিঞ্জের মতো ঢুকিয়ে দেয়। তারপর টানতে সুরা পানের মতো।
রাজধানীবাসী মশার এই উপদ্রবে একদমই বিরক্ত, অতিষ্ঠ। মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে কয়েলের ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও এনিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বাজারের মশার কয়েলও নাকি নগরের শক্ত সামর্থবান মশার সাথে পেরে ওঠে না। এমনকি বাজারে যেসব স্প্রে থাকে সেসবেও তেমন একটা কাজ করে না। এর কারণ হিসাবে বাজারের কয়েল কিংবা স্প্রের বিরুদ্ধে যতটা না অভিযোগ, তারচেয়ে বেশি অভিযোগ মশার বিরুদ্ধে। আসলে মশারাই এতটা চতুর হয়ে উঠেছে যে তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত অস্ত্রই ব্যর্থ হয়ে যায়।
শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে বেড়ে গেছে মশার উপদ্রব, নগরবাসীর মনে ফিরে আসছে ডেঙ্গুর ভয়। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই শীতের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে এবার। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মশাও বাড়ছে। নগরবাসী বলছে, দিনের বেলা কোনোমতে পার হলেও সন্ধ্যার আগে থেকে শুরু হয় মশার উপদ্রব। সিটি করপোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণে নানা কার্যক্রম চালানোর কথা বললেও নগরবাসীর অভিযোগ, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অপ্রতুল।
এবারের শীত মৌসুমে মশার উপদ্রবে ঘরে-বাইরে কোথাও স্বাভাবিক কাজকর্ম করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন নগরবাসী। তারা বলছেন, নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় না। আবার মাঝে মাঝে যে মশক নিধন স্প্রে করা হয় তাও কার্যকর নয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী। একই সঙ্গে তাদের মনে ডেঙ্গু আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ সময়ে কিউলেক্সসহ অন্যান্য মশার আক্রমণে ফাইলেরিয়াসিসসহ চিকুনগুনিয়া রোগেরও ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন নগরবাসী।
রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবর, লালবাগ, সূত্রাপুরসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ ধরে মশার প্রকোপ ব্যাপক বেড়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা বলেন, বিকেল হতেই মশার উপদ্রব শুরু হয়। মশারি টানিয়েও রেহাই পাওয়া যায় না। আবার কয়েলের ধোঁয়া সহ্য হয় না। তাই কয়েলও ব্যবহার করা যায় না।
অভিজাত এলাকা গুলশানকেও ছাড়েনি মশা। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ‘গুলশানে মশার সাংঘাতিক উপদ্রব। এটি একটি অভিজাত এলাকা। সে হিসেবে আশা করেছিলাম হয়তো মশার উপদ্রব থেকে স্বস্তি পাব। এ এলাকায় সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কাজ আছে। কিন্তু মশার উপদ্রব ঠেকাতে সে কাজ যথেষ্ট নয়।
মশা নিধনে করা স্প্রের ওষুধ কাজে আসছে না দাবি করে নগরবাসী বলেন, আমরা দেখি বিকেলে বা সন্ধ্যায় স্প্রে করছে, কিন্তু মশার তো কিছুই হয় না। তা নাহলে রাত হতেই মশার উপদ্রব শুরু হবে কেন? আমরা বলতে চাই, মশা নিধনে যে স্প্রে (ওষুধ) ব্যবহার করা হয় তা কার্যকর কি-না আগে পরীক্ষামূলক ব্যবহার করে ছিটাতে হবে। এছাড়া নগরীতে মশার বৃদ্ধি যাতে না হয় এজন্য কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
তারা বলেন, ‘ঘরে যে মশার যন্ত্রণা, সারা বছরই ফ্যান চালিয়ে রাখি। যাতে মশার আক্রমণ কম হয়, কয়েল আর কতো কেনা যায়। এখন যে কী স্প্রে করে বুঝি না, মশাও মরে না। আবার ডেঙ্গুর ভয় তো আছেই।’
পশ্চিম রামপুরার এক বাসিন্দা গণমাধ্যমকে জানান, ‘যে ওষুধ দেয় তাতে তো মশা মরে না, খালি ধোঁয়া হয়। এভাবে নামমাত্র স্প্রে না করে মশা মারার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ আমরা ঘরেও বসতে পারি না। বাচ্চারা লেখাপড়া করতে পারে না। সন্ধ্যা হলেই মশারির মধ্যে ঢুকতে হয়। তারপরও তো আতঙ্ক থাকে। ডেঙ্গুর কারণে মানুষের যে কষ্ট হয় তা তো দেখেছি। এই শীতে যেন মশার বিড়ম্বনা বেশিই।’
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৮ জানুয়ারি ‘ওষুধের কার্যকারিতা নেই’ উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য লিখিতভাবে আবেদনও করেন কাউন্সিলর হাজি মো. ইবরাহীম।
এবিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দক্ষিণ সিটিতে মশা নিয়ন্ত্রণ অনেক ভালো অবস্থানে আছে। এই শীতের সময়ে কিউলেক্স মশা কিছুটা বাড়ে। মশা নিধনে আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। একই সঙ্গে আমরা নিয়মিত তদারকি করছি।’
এদিকে গত ২৪ জানুয়ারি সচিবালয়ে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি করপোরেশনের গৃহীত কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা সভার শুরুতে ‘রাজধানীতে মশা অসহ্য ও যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। এর আগে ২১ জানুয়ারি অনলাইনে আয়োজিত ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর ও সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য ৮ম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সভাপতির বক্তব্যে এডিস মশার মতো কিউলেক্স ও অ্যানোফিলিসসহ সব ধরনের মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন মন্ত্রী। এ সময় তিনি রাজধানীবাসীসহ দেশের মানুষকে মশার অত্যাচার থেকে মুক্ত রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন। বিশেষ করে, দীর্ঘদিন একই কীটনাশক ব্যবহারে ‘মশা সহনশীল হয়ে যায়’ দাবি করে কার্যকর ওষুধ কেনার পাশাপাশি তদারকি বাড়ানোর তাগিদও দেন।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেল্থ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যে জানা গেছে, হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত এক মাসে ৩২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু এসেছে নানা রেকর্ড নিয়ে। ওই বছর সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইইডিসিআর ২৬৩টি মৃত্যুর তথ্য পাওয়ার পর তার মধ্যে ১৬৪ জনের মৃত্যু ডেঙ্গুর কারণে হয়েছে বলে নিশ্চিত করে।
কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, এখন নগরে মূলত কিউলেক্স মশার উপদ্রব চলছে। স্ত্রী কিউলেক্স মশার মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তির শরীর থেকে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ফাইলেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। ‘গোদ’ নামে পরিচিত এই রোগের কারণে হাত-পা ফুলে যায়। বারবার জ্বর হয়। তারা বলেন, ডেঙ্গুর সময় যেভাবে মশকনিধন কার্যক্রম চালানো হয়েছিল, এখন তা আর নেই। তাই কিউলেক্স মশা বেড়েছে। তবে নতুন করে দুর্যোগ এড়াতে হলে মশকনিধন কার্যক্রমে ঢিলেমি দেওয়া যাবে না। কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এখনই জোর দিতে হবে। মশকনিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। যেসব এলাকায় কিউলেক্স মশা তুলনামূলক বেশি, সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে বলে জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ