আর্সেনিক দূষণ এতটাই গুপ্তঘাতক যাকে স্লো পয়জনও বলা হয়। যার কারণ মূলত মানুষ কর্তৃক ভূগর্ভস্থ পানির বিজ্ঞানবিরুদ্ধ ব্যবহার। এই দূষণ এমনই বিষাক্ত যে দীর্ঘদিন আর্সেনিকযুক্ত পানি ব্যবহারে মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, প্রাণঘাতী ক্যানসার পর্যন্তও হতে পারে। সম্প্রতি ঢাকায় ওয়াসার পানির উপর চালানো এক গবেষণায় একাধিক বিষাক্ত উপাদান এমনকি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী যৌগের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। ক্ষতিকারক এসব উপাদানের মধ্যে আছে- টেক্সটাইল, জাহাজ ভাঙারি, তেল পরিশোধন, প্রসাধন সামগ্রী, পরিষ্কারক এবং শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। দূষিত এই পানি গ্রহণ মারাত্মক স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর্সেনিকের প্রভাব যে শুধু শারীরিক ক্ষতিই করছে, তা নয়; মানবসম্পদের উৎপাদনশীলতা, জ্ঞান এবং উপার্জনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন ইয়েল অর্থনীতিবিদ মার্ক রোজেনজওয়েগ। নতুন একটি গবেষণায় এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি।
ইয়েল নিউজে গতকাল সোমবার(০১ ফেব্রু) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ শতকে বাংলাদেশে আর্সেনিকের যে প্রভাব দেখা গেছে, তাকে ইতিহাসের গণ বিষক্রিয়া বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় আর্সেনিকযুক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের শরীরে যে পরিমাণ আর্সেনিক শনাক্ত হচ্ছে, বাংলাদেশে তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি মাত্রার পাওয়া যাচ্ছে! আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার প্রভাব যাদের শরীরে রয়েছে, তাদের স্কুলে উপস্থিতির সংখ্যা কম। বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রেও এই বাংলাদেশিরা পিছিয়ে থাকছেন।
গবেষকেরা বলছেন, তরুণদের শরীরে যে পরিমাণ আর্সেনিক শনাক্ত হচ্ছে সেটি অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারলে প্রশিক্ষিত চাকরির বাজার ২৪ শতাংশ ত্বরান্বিত হবে। উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়বে ২৬ শতাংশ।
আর্সেনিকের মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের সমান করা গেলে পুরুষদের উপার্জন ৯ শতাংশ বাড়বে। পাশাপাশি নারীদের গৃহস্থালির উৎপাদনশীলতাও বাড়বে।
আর্সেনিক নিয়ে এখন পর্যন্ত যত গবেষণা হয়েছে, তার অধিকাংশ শারীরিক ক্ষতি সম্পর্কিত। ঢাকা ইউনিভার্সিটির মোহাম্মদ নাজমুল হাসানকে নিয়ে করা নিজের বিশ্লেষণে রোজেনজওয়েগ দাবি করেছেন, এই প্রথম তারা অর্থনৈতিক প্রভাব বুঝতে গবেষণা করেছেন।
তাদের আর্টিকেলটি পিয়ার-রিভিউড জার্নাল ‘রিভিউ অব ইকোনমিক স্টাডিজে’ প্রকাশিত হবে। তার আগে এটি অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে।
গবেষণা বলে, ‘বিদ্যমান প্রভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে এটি পারস্পরিক সম্পর্কের পরিণতি। অর্থনৈতিক ফলাফলের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। আণবিক জেনেটিকস বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা সত্যিকারের প্রভাব শনাক্ত করতে পারি।’
১৯৮২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সংগ্রহ করা বিভিন্ন ডেটা বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা বলছেন, আর্সেনিকের প্রভাবে মানবসম্পদ সেক্টর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
২০১৮ সালে বিবিএস ও ইউনিসিএফ প্রকাশিত হিসাবে ১৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ এখনো আর্সেনিকযুক্ত পানি ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে কোন মাত্রায় আর্সেনিক মানুষের শরীর নিতে পারে, তার আন্তর্জাতিক মান আর বাংলাদেশের মান এক নয়। বাংলাদেশের জন্য পানি নিরাপদ পরিমাণ আর্সেনিক হলো ৫০ পিপিবি। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুসারে ১০ পিপিবি পর্যন্ত নিরাপদ ভাবা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যে কোনো বিষয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অন্যতম শর্ত হচ্ছে সঠিক তথ্য ও উপাত্ত। কিন্তু এ বিষয়টি আমাদের দেশে বরাবরই উপেক্ষিত। আর্সেনিকের মতো ধীরলয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রাযুক্তিক ব্যবহার ও গুণগত উপাত্তের সমন্বয় সুদূরপ্রসারী সমাধান দিতে পারে, যা অনেক দেশ করেছে।তারা জানান, যত দূর জানা যায়, আর্সেনিক মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোয় দক্ষ পানি-ভূতত্ত্ববিদের অপর্যাপ্ততাও কার্যকর ব্যবস্থাপনাকে ব্যাহত করছে। এ বিষয়েও নজর দেওয়া উচিত। তারা মনে করেন, যেহেতু আর্সেনিকের প্রভাব মানবদেহে ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হয়, আক্রান্ত জনগোষ্ঠী এটাকে বেশি আমলে নেয় না, তাই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর অগভীর নলকূপ ব্যবহারকারীদের যেকোনো পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত করা অত্যাবশ্যক। যেমন স্থানীয় জনগণকে নলকূপের পানির আর্সেনিক নির্ধারণে প্রশিক্ষণ এবং ফিল্টার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা গেলে সময় ও অর্থ যেমন বাঁচবে, তেমনি বাড়বে গণসচেতনতা। আরেকটি কার্যকর সমাধান হচ্ছে সরকারি নীতিনির্ধারণে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলকে বিবেচনায় নেওয়া। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, বিষয়টি এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে চরমভাবে অবহেলিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ