মানবসভ্যতার ইতিহাসের শুরুটা ছিল ক্ষুধা দিয়ে। যখন আগুন, কৃষি কিংবা সংগঠিত সমাজের ধারণা তৈরি হয়নি, তখন মানুষ কেবল বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করত। এই সংগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল—খাদ্য কোথায় পাওয়া যাবে? বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, মানুষ তখন মূলত ফল, শিকড় ও উদ্ভিদভিত্তিক খাবার খেত, পরে ধীরে ধীরে শিকারি হিসেবে বিবর্তিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই ধারণা হয়তো অসম্পূর্ণ। মানুষের বিবর্তনের এক অবহেলিত অধ্যায় হলো—স্ক্যাভেঞ্জিং বা মৃত প্রাণীর দেহভক্ষণ।
স্পেনের জাতীয় মানব বিবর্তন গবেষণা কেন্দ্রের (CENIEH) বিজ্ঞানী আনা মাতেওস ও হেসুস রদ্রিগেজ তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখিয়েছেন, মানুষ কেবল শিকারি প্রাণী নয়, বরং প্রকৃতির অন্যতম দক্ষ মৃতদেহ সংগ্রাহকও ছিল। তাঁদের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে Journal of Human Evolution–এ, যেখানে প্রত্নতত্ত্ব, জীবাশ্মবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞানের নানা দিক একত্রিত করে মানুষের প্রাচীন খাদ্যাভ্যাস নতুনভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তাঁরা বলছেন, স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের প্রধান সুবিধা হলো—খাদ্য সংগ্রহে তুলনামূলকভাবে অনেক কম পরিশ্রম লাগে। একটি প্রাণীকে শিকার করতে যে পরিমাণ সময়, শক্তি ও ঝুঁকি নিতে হয়, একটি মৃত প্রাণীর দেহ পাওয়া তার তুলনায় অনেক সহজ। আফ্রিকার খোলা প্রান্তরে কিংবা প্রাচীন উপকূলীয় অঞ্চলে যখন বড় প্রাণী মারা যেত, তখন সেই দেহ কয়েকদিন পর্যন্ত ভক্ষণযোগ্য থাকত। মানুষ তখন দলবদ্ধভাবে সেই মৃতদেহ খুঁজে পেত, এবং পাথরের ধারালো টুকরো দিয়ে মাংস কেটে নিত, হাড় ভেঙে মজ্জা বের করত।
দীর্ঘদিন ধরে ধারণা ছিল, মৃত প্রাণীর মাংস খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ তাতে জীবাণু ও রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। কিন্তু মাতেওস ও রদ্রিগেজ দেখিয়েছেন, মানুষের শরীরবৃত্তীয় গঠন এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে তারা এই ঝুঁকি সামলাতে সক্ষম। আমাদের পাকস্থলীর অম্লীয় pH অনেক বেশি শক্তিশালী, যা রোগজীবাণু ও বিষাক্ত উপাদান ধ্বংস করে দিতে পারে। এ ছাড়া, আগুনের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর রান্না করা খাবার সংক্রমণের আশঙ্কা আরও কমিয়ে দেয়।
মানুষের শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গেও স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের গভীর সম্পর্ক আছে। মানুষ দীর্ঘ দূরত্ব হাঁটতে পারে তুলনামূলকভাবে খুব কম শক্তি ব্যয় করে—এটি ছিল মৃত প্রাণীর দেহ খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে বিশাল সুবিধা। অন্যান্য শিকারিরা যেমন নির্দিষ্ট এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, মানুষ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে সম্ভাব্য খাদ্য উৎস খুঁজে বের করতে পারত। আর ভাষার বিকাশ এই প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করে তোলে। প্রাথমিক ভাষা বা ইঙ্গিতভিত্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে তারা একে অপরকে জানাতে পারত কোথায় মৃত প্রাণীর দেহ পাওয়া গেছে, বা কীভাবে শিকারির আক্রমণ থেকে নিরাপদে খাবার সংগ্রহ করা যায়।
এই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, মানুষের প্রাচীন সরঞ্জামগুলোর অনেকগুলিই আসলে শিকার নয়, বরং মৃতদেহ কেটে মাংস আলাদা করার জন্য ব্যবহৃত হতো। সহজ পাথরের ফ্লেক দিয়ে বড় প্রাণীর মোটা চামড়া কাটা যেত, আর হাড় ভাঙার জন্য ব্যবহৃত পাথর হাতুড়ির মতো কাজ করত। এগুলো ছিল স্ক্যাভেঞ্জিং–নির্ভর জীবনের মূল উপকরণ।
অন্যদিকে, পরিবেশবিজ্ঞানও এই ধারণাকে সমর্থন করছে। নতুন পর্যবেক্ষণ বলছে, মৃত প্রাণীর দেহ প্রকৃতিতে একদম অপ্রচলিত নয়। বরং এটি বহু প্রজাতির জন্য নির্ভরযোগ্য খাদ্য উৎস, বিশেষত যখন শিকার বা উদ্ভিদ কম পাওয়া যায়। বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী বা সামুদ্রিক প্রাণী মারা গেলে, তাদের দেহ একই সঙ্গে অনেক জীবের খাদ্যের চাহিদা মেটায়। এই অবস্থায় মানুষও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে সহাবস্থানে মৃতদেহ ভাগাভাগি করে খেত।
তবে স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল বিপদের সম্ভাবনাও। যখন মানুষ মৃত প্রাণীর দেহের কাছে যেত, তখন সিংহ বা হায়েনার মতো শিকারিরা সেখানে উপস্থিত থাকতে পারত। তাই মানুষকে কৌশলে সংগঠিতভাবে কাজ করতে হতো—কখনও পাথর ছুঁড়ে শিকারিকে দূরে সরানো, কখনও দলবদ্ধভাবে আওয়াজ করে ভয় দেখানো। এই অভ্যাস দলীয় ঐক্য ও কৌশলগত চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটায়, যা পরবর্তী সময়ে সামাজিক সংগঠন ও সহযোগিতামূলক আচরণের ভিত্তি তৈরি করে।
১৯৬০-এর দশকে আফ্রিকার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে পাওয়া প্রমাণ থেকে জানা যায় যে প্রাচীন হোমিনিন বা মানব-পূর্বপুরুষরা প্রাণীর মাংস খেত। তখন থেকেই বিতর্ক শুরু হয়—তারা কি নিজেরাই শিকার করত, নাকি মৃত প্রাণীর দেহ সংগ্রহ করত? অনেক বছর ধরে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধরে নিয়েছিলেন, মানুষ দ্রুত শিকারি হয়ে ওঠে এবং মৃতদেহভক্ষণ পরিত্যাগ করে। কারণ, পশ্চিমা চিন্তাধারায় শিকারি প্রাণীদের দেখা হয় শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ অবস্থানে থাকা প্রাণী হিসেবে, আর মৃতদেহভক্ষণকে “অপবিত্র” বা নিম্নস্তরের কাজ বলে মনে করা হয়।
কিন্তু নতুন যুগের গবেষণা এই ধারণাকে উল্টে দিয়েছে। আধুনিক পরিবেশবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, পৃথিবীর প্রায় সব মাংসাশী প্রাণীই কোনো না কোনোভাবে মৃত প্রাণীর দেহ খায়। এমনকি শীর্ষ শিকারি হিসেবে বিবেচিত সিংহ বা বাঘও কখনো কখনো মৃত প্রাণীর দেহ ভক্ষণ করে। ফলে, স্ক্যাভেঞ্জিং কোনো নিম্নস্তরের আচরণ নয়, বরং প্রকৃতির খাদ্যচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মানুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি আলাদা নয়। আজও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক শিকারি–সংগ্রাহক সমাজে স্ক্যাভেঞ্জিং একটি সাধারণ খাদ্যসংগ্রহ পদ্ধতি। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার কিছু উপজাতি এখনো মৃত প্রাণীর হাড় থেকে মজ্জা বের করে খায়, যা অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সহজলভ্য প্রোটিন উৎস।
এই সব পর্যবেক্ষণ এক নতুন উপলব্ধি এনে দেয়—যেমন একসময় বলা হতো “মাংস খাওয়াই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে,” তেমনি এখন বলা যায়, “মৃত প্রাণীর দেহ খাওয়াই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে।” কারণ, এই প্রক্রিয়া শুধু খাদ্য সংগ্রহের কৌশল নয়, বরং মানুষকে সহযোগিতা, যোগাযোগ, সরঞ্জাম ব্যবহার ও আগুন নিয়ন্ত্রণের মতো বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌঁছে দিয়েছে।
মৃত প্রাণীর দেহভক্ষণ হয়তো আজ আমাদের কাছে ঘৃণার বিষয়, কিন্তু প্রায় ২০–৩০ লাখ বছর আগে এটি ছিল টিকে থাকার একমাত্র উপায়। সেই প্রাচীন ক্ষুধা ও কৌশল থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় শিকার, রন্ধনশিল্প, সমাজবোধ ও সভ্যতা। মানুষ যখন একটি মৃতদেহের পাশে পাথর হাতে দাঁড়িয়েছিল—তখনই হয়তো প্রথমবার বুঝেছিল, কৌশল ও সহযোগিতাই বেঁচে থাকার প্রকৃত অস্ত্র।
আপনার মতামত জানানঃ